"ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো। চাঁদ হেলে পড়লো পশ্চিমে। উঠোনের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো। পরীর দীঘির পারে একটা রাতজাগা পাখির পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা গেলো। রাত বাড়ছে। হাজার বছরের পুরনো সেই রাত।" (হাজার বছর ধরে)।
মানুষের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে কত হাজার দিন, কত হাজার রাত। মনুষ্যজীবনের চলমান এই হাজার হাজার রাতের ছবি, দিনের ছবি ধরে রাখেন লেখক। তাঁরই বোধহয় দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। নানা ভঙ্গিমায় লেখক এই ছবি ফ্রেমে আটকে রাখতে চান। কথা রুদ্র থেকেই বিরাট হয়ে দাঁড়ায়। উপন্যাস এই কথা বলার অধিকার দেয় কথাসাহিত্যিককে, তার ক্যানভাস ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তব্যাপী। চল্লিশ দশকে বাংলাদেশের উপন্যাসশিল্পের অগ্রযাত্রায় যাঁদের লেখনীচর্চা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল সেই সৈয়দ ওয়ালিউলস্নাহ, শওকত ওসমান, আবুল ফজল, সরদার জয়েন উদ্দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবু ইসহাক-এঁদের পথ ধরে পঞ্চাশ দশকে আরেকদল শক্তিশালী লেখকের আবির্ভাব ঘটে। চল্লিশের ধারার উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিককে সামনে রেখেই পঞ্চাশের লেখকরাও উপন্যাসধারাকে এগিয়ে নিয়েছিলেন অনেকদূর। গ্রামীণ পটভূমি, শ্রেণীচেতনা ও শ্রেণীযুদ্ধ, উচ্চাভিলাষী নাগরিক মধ্যবিত্তের প্রেম ও মনোবিকলন, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন তথা দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতির প্রেক্ষাপট_ সব কিছুকেই তুলে এনেছিলেন তাঁরা উপন্যাসের ভাষায়। কোন কৃত্রিমতা ছিল না, ছিল না ফানুসি বর্ণনা। কাহিনী, চরিত্রসৃষ্টিতে তাঁরা ছিলেন আন্তরিক। জহির রায়হান এই ধারারই ঔপন্যাসিক। কিন্তু উল্লখিেত ধারার লেখক হলেও তাঁর চিন্তাচেতনা ছিল ভিন্ন, একটু আলাদা মাত্রার। বিষয় নির্বাচনে, চরিত্রসৃষ্টিতে, ভাষার ঋজুতায় তাঁর স্বাতন্ত্র্যবোধ সমসাময়িক আলাউদ্দীন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, রশীদ করিমদের থেকে একটু দূরে। জহির রায়হান মূলত নাগরিক লেখক, নগরকেন্দ্রিক ঘটনাবলী তাঁর উপন্যাসের বিষয়। সাতটি উপন্যাসের মধ্যে কেবলমাত্র 'হাজার বছর ধরে' ছাড়া অন্য সবের পটভূমি শহর বা নগর। জহির রায়হানের উপন্যাসসমগ্রকে তিনটি পর্বে ভাগ করলে এর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো সহজেই পাঠসীমায় আনা যায়।
১. আরেক ফাল্গুন ও আর কতদিন
২. হাজার বছর ধরে
৩. শেষ বিকেলের মেয়ে, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা ও কয়েকটি মৃত্যু।
১ : ক_ দু'টি উপন্যাসই নগরকেন্দ্রিক, উপন্যাস দু'টিতে ইতিহাস, রাজনীতি, আনত্মর্জাতিকতা, যুদ্ধবিরোধিতা, সংগ্রামী জীবন এবং আগামীদিনে একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত নতুন পৃথিবী গড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু উপন্যাস দু'টি কি নিছক বক্তব্যভিত্তিক, সেস্নাগানসর্বস্ব? কাহিনী নির্মাণ ও চরিত্রসৃষ্টি কিংবা বলি মানবিক উপাদান; সবই এর মধ্যে জমাটবুননীর মতো স্থান পেয়েছে। 'আরেক ফাগুন' এদেশের ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস। আজ পর্যন্ত যত ভাষা আন্দোলন অবলম্বনে উপন্যাস লেখা হয়েছে তার মধ্যে জহির রায়হানের 'আরেক ফাগুন' মহৎ ও সার্থক উপন্যাস। উপন্যাসটি লেখার সময় তাঁর ব্যস্ততা ছিল তুঙ্গে। ১৯৬৯-এ, অই সময় তিনি আরেকটি মহত্তম রাজনৈতিক সৃষ্টি 'জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্রায়নে নিমগ্ন। এত ব্যসত্মতার ফাঁকেও তিনি অই বছর একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিলেন। যেন তিনি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আগুনে ঘি ঢালার আয়োজন করেছিলেন। একুশ বিষয়ে অনেক গল্প থাকা সত্ত্বেও কেন এই বিষয়ে উপন্যাস লেখার তাগিদ অনুভব করেছিলেন জহির রায়হান? একটি জাতির উন্মেষাকাঙ্ৰাকে, সকল রক্তচক্ষু এড়িয়ে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামকে, দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের হৃদয়ে আমূলপ্রোথিত করার অভিপ্রায়ে 'আরেক ফাগস্নুন' উপন্যাসের সৃষ্টি। ইতিহাস ও উপন্যাস দুটোর প্রতিই তিনি বিশ্বসত্ম থাকার চেষ্টা করেছেন এবং সার্থক এখানেই তিনি, ব্যক্তি অভিজ্ঞতার আলোকে ইতিহাসের সূত্র ধরেই মাতৃভাষাকে নিয়ে একটি জাতির মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ইতিহাস উপন্যাসের আঙ্গিকে উপস্থাপনা, সত্যবাসত্মবতাকে পাশ কাটিয়ে যায় না বরং আরো শিকড়সন্ধানে ব্যাপৃত হয়। আমরা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের শিকড় অনুসন্ধানে আগ্রহী নই, কিন্তু মুখে মুখে এদের নিয়ে আহামরি বাচালতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি এবং এর উল্টো বিষয়ে উদ্বাহু নৃত্যে মাতোয়ারা হয়ে উঠছি। জহির রায়হান 'আরেক ফাল্গুন' না লিখলে আমরা একুশের দলিল পেতাম, উপন্যাস পেতাম না। একুশের ইতিহাস বিকৃত না হয়ে উপন্যাসে সেই ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ ঠিক রেখে উপন্যাস সরল ভাষায় এগিয়ে যায়। 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ও বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির কর্মসূচীর মিল লৰ্য করা যায়। শহীদ স্মৃতিসত্মম্ভ নির্মাণ, কালো ব্যাজ পরে বিভিন্ন শিৰা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একত্র হওয়া, বিভিন্ন সেস্নাগানসহ বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশী অভিযান, ছাত্রছাত্রীদের গ্রেফতার হওয়া_ সবই ঐতিহাসিক সত্য কিন্তু কাহিনীর বর্ণনা, এর গতি, চরিত্র নির্মাণ, ভাষা সব মিলিয়ে তা হয়ে ওঠে একটি আসত্ম উপন্যাস। উপন্যাস পড়লে জহির রায়হানকে আর ঐতিহাসিক বলে ভাবি না, তিনি তখন প্রকৃতই একজন ঔপন্যাসিক।
উপন্যাসটি আরম্ভ হয়েছে ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের অতীত ইতিহাস দিয়ে। এর পর নায়ক মুনিম নগ্নপদে হেঁটে যাচ্ছে_ 'আকাশের অনেক নীচু দিয়ে মন্থরগতিতে ভেসে চলেছিলো এক টুকরো মেঘ। উত্তর থেকে দৰিণে। ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে ঠিক সেই মেঘের মত একটি ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা গেল নবাবপুরের দিকে। দৰিণ থেকে উত্তরে।' তার ধোপদুরসত্ম কাপড়চোপড় অথচ নগ্নপদ দেখে রাসত্মার আশপাশের লোকজন অনেক কিছু ভাবলো। এরপরই তার সঙ্গে যোগ দিল আরেকটি ছেলে আসাদ, সেও নগ্নপদে। হাঁটতে হাঁটতে তাদের সংখ্যা দশজন হয়ে গেল, সবাই নগ্নপদ; ওদিক থেকে আরো কয়েকজন মেয়ে_ রানু, বেনু, নীলা, সালমা। এরা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রী। এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। একদিকে মুনিম, আসাদ, কবি রসুল, রাহাত, মাহের, রওশন, সালমা, বেনু, রানু, নীলা: এরা আত্মপ্রত্যয়ী, প্রতিবাদী, সংগ্রামী, মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ; অন্যদিকে মাহমুদ, কিউ খান, রশীদ, বজলে, সাহানা, ডলি : সুবিধাবাদী, আপোসকামী, স্বার্থান্ধ। আবার আপোসহীন ছাত্রনেতাদের কার্যকলাপে কোন অলৰ্যে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায় অধ্যাপক, কেরানি, হোটেলওয়ালা মতিভাই, মধুর রেসত্মরাঁর মধুদা। এর মধ্যেও নর-নারীর পারস্পরিক প্রেমবোধ, প্রেমের স্বার্থকতা, ব্যর্থতার চিত্র পাঠকের দৃষ্টিসীমায় চলে আসে। 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসের ঘটনার কাল '৫২ নয়, তার তিন বছর পরের, কেননা কবি রসুলের জবানে '৫২-এর একুশে ফেব্রম্নয়ারিতে বরকতের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার কাহিনীটি বিবৃত হয়েছে। উপন্যাসের গতি দ্রম্নততা লাভ করে একুশে ফেব্রম্নয়ারির আগের রাত থেকে। পরদিন কালো পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হলের ছাদে ছাত্রদের মুহমর্ুহু সেস্নাগান উচ্চকিত হতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনাও বাড়তে থাকে। ছাত্র ও পুলিশ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। বাকবিত-ার এক পর্যায়ে শুরম্ন হয় পুলিশী অভিযান। শ'খানেক পুলিশ অর্ধবৃত্তাকারে ছুটে আসছে ছাত্রদের দিকে। মাথায় ওদের হেলমেট, হাতে একটা করে লাঠি। লোহার নাল লাগানো বুট জুতো দিয়ে শ্যামল দূর্বাঘাস মাড়িয়ে ছুটে আসছিলো ওরা।' প্রচ- আঘাতে আহত হলো আসাদ, রাহাত। প্রথম গ্রেফতার হলো আসাদ। আসাদের মনে পড়লো বাহান্ন সালে এমনি দিনে প্রথম যে দশজন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলো তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলো সে। সেদিনও প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলো সে। আসাদের চরিত্রটি কি জহির রায়হান নিজে? শ'য়ে শ'য়ে ছাত্রছাত্রীকে গ্রেফতার করে জেলখানায় আনা হলো। কিন্তু সেখানে এত জায়গা কোথায়? তাই কবি রসুলের কণ্ঠে শোনা যায়_ 'জেলখানা বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না।' আরেকজন বললো_ এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দিগুণ হবো।' একাত্তরের ফাল্গুনেই কিন্তু এদেশের মানুষ দ্বিগুণ থেকে কয়েকগুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে । জহির রায়হানের রাজনৈতিক সচেতনারই উজ্জ্বল সাৰ্য 'আরেক ফাল্গুন।'
১: খ_ পৃথিবীর নির্যাতিত, নিগৃহীত মানুষের সপৰ উচ্চারণ 'আর কতদিন' উপন্যাস। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উন্মত্ততা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর শানত্মিকামী মানুষকে করেছে বিপর্যসত্ম, দিশেহারা, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, জাতীয়তার নামে, সংস্কৃতির নামে মানুষ আত্মহুতি দিয়েছে বার বার। এই নির্মম আত্মহুতির বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে সুস্থ মানবতা, এর মধ্যেই বাঁচার বীজমন্ত্র খুঁজেছেন জহির রায়হন, প্রশ্ন করেছেন সুস্থ বিবেককে_ আর কতদিন চলবে এই সবের পুনরাবৃত্তি? অন্ধকার থেকে আলোতে আসার পথ তৈরি করতে চেয়েছেন জহির রায়হান। বলেছেন_ অন্ধকারের পেছনে আছে আলো, দুঃখের পরে সুখ। 'আর কতদিন' উপন্যাস অবলম্বনে জহির রায়হান শুরম্ন করেছিলেন 'লেট দেয়ার বি লাইট' ছবিটি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন হওয়ায় তা অসমাপ্ত থেকে যায়। ছবিটি নির্মিত হলে হয়তো জহির রায়হান আনত্মর্জাতিক মানের আরও একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র রেখে যেতেন। 'আর কতদিন' সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য ধরনের লেখা।
মাত্র চৌত্রিশ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে চরিত্রের সংখ্যা অতি নগণ্য এবং সব চরিত্রই প্রতীকধমর্ী। তপু, ইভা, বিভিন্ন বয়সের কয়েক নরনারী, বুড়ি মা, বুড়ো বাবা, তাদের তিন সনত্মান, একজন সনত্মানসম্ভবা মহিলা, এদের কোন নাম নেই। একটি মৃতপ্রায় নগরী এই উপন্যাসের পটভূমি, যে নগরীটির সমসত্ম কিছুই কারা যেন তছনছ করে দিয়ে গেছে। যেন যুদ্ধে ৰতবিৰত তার অবয়ব, সেখানে কেবল কবরের শূন্যতা। চারদিকে ভাঙ্গা কাঁচ, ইটের টুকরো আর মৃতদেহ। মৃতদেহগুলো কুকুরের, বিড়ালের, পাখির, মানুষের_ অগুনতি। জীবনের স্পন্দনে মুখরিত এ নগরীর অবস্থা এ রকম করলো কারা? তারা অসংখ্য জানোয়ার। তারা পাগলা কুকুর, তারা রক্তপিপাসু সিংহ, বাঘ; তারা মারমুখী শূকর-শূকরী। জহির রায়হান দেখিয়েছেন বিপর্যসত্ম, মানবতা, যার ঘাড়ে জগদ্দলের মতো চেপে বসেছে নিষ্ঠুর শাসক, অত্যাচারী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এদের ভয়ে একটি ঘরে লুকিয়ে আছে কিছু মানুষ_ ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, যুবক-যুবতী ও একজন সনত্মানসম্ভবা মহিলা। তারা ভয়ার্ত, সন্ত্রসত্ম; তাদের চোখে মৃৃতু্যর ছায়া। অন্য দৃশ্য: তপু ছুটছে যেন পালাছে। তাকে তাড়া করছে কারা? সেই পশুরা। ইভাকে নির্যাতন করছে কারা? সেই একই পশুরা। শুধু ইভাকে পায় তপু, তারপর আবার সেই ছোটা, পেছনে জানত্মব চিৎকার, তারা আশ্রয় নেয় গির্জায়, সেখানেও একই চিৎকার_'বের করে দাও ওদের।' একটি পথ ধরে মিছিল চলছে_ 'ছেলে, বুড়ো। মেয়ে। শিশু। যুবক। যুবতী। দীর্ঘ পথ চলায় ক্লানত্ম। অবসন্ন। জীর্ণ, শীর্ণ। বিবর্ণ। ৰতবিৰত দেহ। নানান গোত্রের। নানান ধর্মের। নানা বর্ণের। কোথা থেকে আসছো? ইন্দোনেশিয়া থেকে। ভিয়েতনাম থেকে। গ্রীস থেকে। জেরম্নজালেম থেকে। হিরোশিমা থেকে। কোথায় যাচ্ছো? আমরা অন্ধকার থেকে আলোতে যেতে চাই।' আজ, এতদিন পরেও সমগ্র বিশ্বের দিকে তাকালে 'আর কতদিন' উপন্যাসের প্রেৰাপট উপলব্ধি করতে অসবিধা হয় না। জহির রায়হান তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীটিকে বিশ্বমানবতার দিকে প্রসারিত করেছিলেন বলে 'আর কতদিন' সার্থক উপন্যাসের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। 'আর কতদিন' উপন্যাসের আবেদন চিরকালীন।
২. 'হাজার বছর ধরে' জহির রায়হানের সাতটি উপন্যাসের মধ্যে এই একটি গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত। এইখানে জহির রায়হান ভিন্ন এক মানুষ। এই উপন্যাসটি বিভৃতিভূষণের 'পথের পাঁচালী', তারাশঙ্করের 'পঞ্চগ্রাম', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি', অদ্বৈত মলস্নবর্মনের 'তিতাস একটি নদীর নাম', শহীদুলস্নাহ কায়সারের 'সারেং বৌ, সংশপ্তক', আলাউদ্দীন আল আজাদের 'কর্ণফুলী', আবু ইসহাকের 'সূর্যদীঘল বাড়ী', শামসুদ্দীন আবুল কালামের 'কাশবনের কন্যা' সমগোত্রীয়। এই উপন্যাসে বিশেষ এক এলাকার মানুষের সহজ-সরল জীবনধারা ফুটে উঠেছে। শিকদার বাড়ি থেকেই কাহিনী শুরম্ন, আসত্মে আসত্মে তার ডালপালার বিসত্মৃতি ঘটেছে। একটা দীঘিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গ্রাম। দীঘিকে ঘিরে নানা কিংবদনত্মি আছে। লোকে বলে পরীর দীঘি। অনেক চরিত্র, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। বুড়ো মকবুল, তার তিন স্ত্রী_ আমেনা, ফাতেমা, টুনী; আবুল ও তার স্ত্রী হালিমা, আম্বিয়া, মন্তু, সুরত আলী, সালেহা, হীরন_ সবাই বাংলাদেশের হাজার গ্রামের একটি গ্রামের মানুষ। মকবুলের ছোট স্ত্রী কিশোরী টুনি আর মন্তুর অস্পষ্ট প্রেম (প্রকাশ্য নয়) এই উপন্যাসের একটি উপজীব্য বিষয়। মূলত মন্তু আর টুনী এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা। টুনীর উচ্ছলতাই মন্তুকে সাহস যোগায়। রাত থাকতে মাছ ধরতে যায়, কখনো শাপলা তোলে। তাদের প্রেম দুরনত্ম নয়, এই নিয়ে কেউ কিছুভাবে না। ভাবে টুনী। মকবুলের সংসারে সে আছে মাত্র, সংসার সে বোঝে কম, গ্রাম বাংলার বাল্যবধূর এক বধূ টুনী। মন্তুর প্রতি টুনীর ভালবাসা (অবৈধ?) নানাভাবে প্রকাশ পায় টুনীর আচরণে। টুনী বাপের বাড়ি যাওয়ার পর মন্তু যখন তাকে আনতে যায়, সেই সময় থেকে টুনীর অবরম্নদ্ধ প্রেম যেন প্রাণ ফিরে যায় আর তখন 'আকাশে জ্যোৎস্নার বান ডাকে। ভরা চাঁদ খলখলিয়ে হাসে। দৰিণের মৃদুমন্দ বাতাস অতি ধীরে চিরম্নণি বুলিয়ে যায় গাছের পাতায় পাতায়। মন্তুও যেন চিনত্মায় সাহসী হয়ে ওঠে। টুনীকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে সে। চলে যাবে দূরে, বহুদূরে কোন গ্রামে কিংবা শহরে। শানত্মির হাটে নিয়ে যাবে ওকে, সেখানেই টুনীকে নিয়ে সংসার পাতবে সে। কিন্তু সংযত জহির রায়হান। মন্তু-টুনীর প্রেমকে এগোতে দেন না, টুনীর কষ্ট, দুঃখ সবই তার কাছেই থেকে যায়। বুড়ো মকবুলের মৃতু্যর পর টুনী এখানকার পাট চুকিয়ে দিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় মন্তুকে বলে_'আমাগো বাপের বাড়ি পেঁৗছাইয়া দিয়া আইবা? বড় ইচ্ছা আছিল তোমার বিয়া দেইখা যামু, তোমার হাতে মেন্দি পরায়া যামু। থাকন আর গেল না।' মন্তুর অনত্মর বিদ্রোহ করে। তাই শানত্মিরহাটে নৌকা ভিড়ায়। বিস্মিত টুনীকে বলে_'মনোয়ার হাজীরে কথা দিছিলাম ওর ওইখানে এক রাতের লাইগা নাইয়র থাকুম। চল যাই।' আবেগে গলা কেঁপে যায় মন্তুর। আর 'টুনীর দেহটা ধরে কে যেন একটা সজোরে নাড়া দিল। মুহূর্তে চোখজোড়া পাথরের মত স্থির হয়ে গেল। .....টুনীর চোখের কোণে দু'ফোটা জল চিকচিক করছে।' তার কণ্ঠস্বর চাপা কিন্তু যেন আর্তনাদের মতই শোনায়_ 'না, তা আর অয় না মিয়া। তা হয় না।' বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। টুনীর এই কান্নায় পাঠকের মনও আদর্্র হয়ে ওঠে। 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসে আরও আছে সমাজের বিভিন্ন দিক, আছে সাংসারিক অশানত্মির চিত্র। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো গ্রামের মতই চরিত্রগুলোর সরলতা আর আমাদের ভাবতে হবে আজকের সময়ের গ্রাম নয়_ ষাট বা পঞ্চাশ দশকের কোন একটি গ্রাম, নিসত্মরঙ্গ জীবনযাপন, একান্নবতর্ী পরিবার : সবই ফুটে তোলার চেষ্টা করেছেন লেখক। তিনি এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে আপনমনে যেন বাড়তে দিয়েছেন, তারা নিজেরাই স্ব-স্ব ৰেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা দাবি করে। 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসটি লিখে জহির রায়হান জাত লেখকের দায়িত্ব পালন করেছেন। নাগরিক মানুষ হয়ে গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসটি পরিপূর্ণ মূল্যায়নের অপেৰা রাখে। সাতটি উপন্যাসের মধ্যে হঠাৎ করে এই উপন্যাসটি লিখে জহির রায়হান যেন আমাদের উৎসের অসত্মিত্বের অনুসন্ধান করেছেন।
৩. 'শেষ বিকেলের মেয়ে', জহির রায়হানের প্রথম উপন্যাস, নগরপ্রধান মধ্যবিত্ত জীবনের প্রেম ও মনোবিকলন স্থান পেয়েছে। এই উপন্যাসের কাসেদ, মা জাহানারা, শিউলি, নাহার, সালমা, বড় সাহেব, মকবুল সাহেব ও তার তিন মেয়ে_ মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবেন কেউই অপরিচিত নয়। প্রেম ও প্রয়োজনে এই চরিত্রগুলো কাছাকাছি এসেছে, আবার দূরেও চলে গেছে। জাহানারা_ শিউলির সরব প্রেমের চাইতে নাহারের নীরব প্রেমই তাকে শেষ বিকেলের মেয়ে হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সে ভালবাসার রঙে কাসেদকে রাঙিয়ে দেয়। কাসেদের মনে নানা ধরনের দোদুল্যমানতা তার মধ্যবিত্ত অসাড়তাকে তুলে ধরে। সে জাহানারা_শিউলিকে নিয়ে ভাবে, ভাবে মকবুল সাহেবের মেয়েকে নিয়ে, কিন্তু যাকে নিয়ে কোনদিন ভাবেনি, সেই নাহার, কাসেদকে নীরবে ভালবেসেছে, তাকে জানতে দেয়নি। তার অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়। কিন্তু যখন 'কোথাও মেঘের রঙ কালো, কোথাও সাদা, কোথাও ঈষৎ লাল। আরও দূরে আকাশে একটা চিল একা একা ঘুরছে। শেষ বিকেলের সোনালি আভায় মসৃণ পাখাটা চিকচিক করছে তাঁর'_ ঠিক এমনি সময়ে নাহার বিয়ের বাড়ি থেকে ছুটে চলে আসে কাসেদের কাছে, যে বাড়িতে তার কেটেছে অনেক দিন_ হলুদের সাজ তখন তার শরীরে। বিস্মিত কাসেদের প্রশ্নের উত্তরে সে জানায়_ 'আমার বিয়ে হয়ে গেছে। কার সাথে? যার সাথে হয়েছে তার কাছেই তো এসেছি।' উপন্যাসের কাহিনীকে শেষ পর্যনত্ম জহির রায়হান মানুষের ইপ্সিত আকাঙ্ৰাকে বাসত্মবে রূপ দেন। প্রথম উপন্যাস হলেও বাসত্মব অভিজ্ঞতা তাঁকে পরিণত লেখক হতে সাহায্য করে। 'বরফ গলা নদী' একটি সার্থক উপন্যাসের লৰণ নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়। এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র জহির রায়হান দরদ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এটিও নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের হতাশা, ক্লানত্মি, টানাপোড়েনের উপন্যাস। মূলত উপন্যাসের নায়ক মাহমুদকে ঘিরেই অন্য চরিত্রগুলো আবর্তিত হয়েছে। মাহমুদ, তার বাবা হাসমত আলী, মা সালেহা বিবি, বোন মরিয়ম, হাসিনা, দুলু, ছোট ভাই খোকন : এই নিয়ে পরিবার। জরাজীর্ণ একটি বাসায় গাদাগাদি তাদের অবস্থান, অভাব নিত্যদিনের সঙ্গী। মাহমুদ সাংবাদিকতা করে, রাত জাগে, মরিয়ম ছাত্রী পড়ায়, এই টানাটানির সংসার তবু যা হোক চলে যেতো, যেমন অনেক মধ্যবিত্তদের যায়। কাহিনীর প্রয়োজনে এসেছে লিলি, মরিয়মের বান্ধবী, মনসুর, সেলিনা, তসলিম। জহির রায়হান এই উপন্যাসে মানুষের বাঁচার আকাঙ্ৰাকে বেগবতী নদীর মত রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। মানুষ তাই চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু 'সব কিছু করতে পারে সে?' যদি পারতোই তাহলে মাহমুদ তার পরিবারের মর্মন্তুদ ট্রাজেডি এড়াতে পারলো না কেন? জীর্ণ নড়বড়ে একটি বাড়ির মানুষদের শুধু আর্থিক অনটনের কারণে বাসাবদল করা সম্ভব হয় না, কিন্তু উচ্চাশারও শেষ হয় না। শেষ পর্যনত্ম সেই প্রাণস্পশর্ী ঘটনা। প্রবল বর্ষণে সমগ্র বাড়িটা ধসে গিয়ে যাদের মৃতু্য হলো তারাতো বাঁচতেই চেয়েছিল, এর দ্বারা জহির রায়হান পরাজিত মধ্যবিত্ত সত্তাকেই উদঘাটন করতে চান। মাহমুদের শেষ আশ্রয় হয় লিলির কাছে, বাড়ির গ্রম্নপ ফটো দেখে যখন সে কাঁদে, যখন সে কাঁদে, বিপর্যসত্ম মাহমুদই তাকে সানত্ম্বনা দেয়_ 'কেন কাঁদছো লিলি? জীবনটা কি কারো অপেৰায় বসে থাকে? আমাদেরও একদিন মরতে হবে। তখনো পৃথিবী এমনি করে চলবে। তার চলা বন্ধ হবে না কোনদিন। যে শক্তি জীবনকে চালিয়ে নিয়ে চলেছে, তার কি কোন শেষ আছে?' শেষ পর্যনত্ম জহির রায়হান আশাবাদী। 'কয়েকটি মৃতু্য' উপন্যাসে কোন মৃতু্য নেই, সেখানে কারো মৃতু্য হয় না, কিন্তু মৃতু্যভয় আছে, ভয়টি পাথরের মত চেপে বসে বুকে। মৃতু্যকে কি এড়ানো যায়, এড়াতে পেরেছে কেউ_ এ উপলব্ধি আসে এই উপন্যাসের বয়স্ক চরিত্র বাবা আহমদ আলীর মধ্যে। তিনিও নগরকেন্দ্রিক উচ্চ মধ্যবিত্ত চরিত্রের এক মানুষ। শহরে তার নিজস্ব আবাস। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে সবাই প্রতিষ্ঠিত। তার কোন অভাব নেই। স্ত্রীও বিদ্যমান। স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ নাতি-নাতনিদের এক ঘরে ডেকে নিয়ে এসে বসান আহমদ আলী শেখ। তারপর চেয়ে তাদের দেখেন। একজন চাষী যেমন করে ফসলভরা ৰেতের দিকে চেয়ে থাকে তেমনি সবার দিকে তাকিয়ে দেখেন আর আলস্নাহর কাছে মোনাজাত করেন।' একদিকে জীবন আর একদিকে মৃতু্য_ দুইয়ের অভিব্যক্তি আহমদ আলী আর ছেলেদের সংলাপ, আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে। মৃতু্যভয়ে ভীত আহমদ আলীর একটু আগের যে পরিতৃপ্তি, তা উধাও হয়ে যায়। সবাইকে ডাকেন, এবার আগের উল্টোচিত্র দৃশ্যমান হয়_ 'বুড়ো কর্তা সবার মুখের দিকে একবার করে তাকালেন। ছেলেদের দেখলেন। বউদের দেখলেন। আমেনাকে দেখলেন। রসুল আর পেঁচিকে দেখলেন। নিজের গিনি্নর দিকে তাকালেন। 'ভরা ফসলের ৰেত্রে পোকা-পড়ার পর অসহায় আতঙ্ক নিয়ে একজন চাষী যেমন করে তাকিয়ে থাকে তেমন করে।' জহির রায়হান মানুষের জীবন ও মৃতু্যর দোলাচলকে চমৎকার উপমা প্রয়োগে প্রাণবনত্ম করে তুলেছেন। পরিশেষে বাড়ির চাকর আবদুলের স্ত্রীর সদ্যোজাত শিশুর ক্রন্দনে সকলের মৃতু্যভয় কেটে যায়। সদ্যোজাত শিশুটি এই বাড়িতে জীবনের স্পন্দন ফিরিয়ে আনলো।
'গিনি্ন হেসে বললেন_ দাঁড়ায়ে রইলে কেন, অজু করে এসো, তাড়াতাড়ি আজান দাও।' আহমদ সাহেবের এক নাতি তখনো পড়া মুখসত্ম করছে_ 'আলস্নাহতায়ালা বলিলেন। হে ফেরেসত্মা শ্রেষ্ঠ ইবলিশ, আমি তামাম জাহানের শ্রেষ্ঠ জীব ইনসানকে পয়দা করিয়াছি। ইহাকে সেজদা করো। ইবলিশ তবু রাজি হইল না। তবু সেজদা করিল না।' জীবনমৃতু্যর দোলাচলে এই পৃথিবীর সমসত্ম মানুষ যে রূঢ় বাসত্মবতার মুখোমুখি হয় তারই নিখুঁত ছবি উদ্ভাসিত এই উপন্যাসে।
'তৃষ্ণা' শহরকেন্দ্রিক উপন্যাস। এ তৃষ্ণা বাঁচার তৃষ্ণা, পিপাসার্ত মানুষের আকণ্ঠ জীবনসুধা পানেচ্ছা, যা উন্যাসের নায়ক শওকতের ছিল, খ্রীস্টান মার্থা গ্রাহামের ছিল, নাচের মেয়ে সেলিনার ছিল, ছিল সেই মাতাল বউ-মারা কেরানিটার, আরো অনেক বাঁচার আশা ছিল রকে বসা সেই কুষ্ঠ রোগীটার। এই উপন্যাসে জহির রায়হান ডিটেলসের আশ্রয় নিয়েছেন, যে ডিটেলস-এ নিখুঁত চিত্র উঠে আসে। শহরের অনেক বড় এক ভাড়াটে বাড়ি, যে বাড়িতে শওকত থাকতো। এখানে বিচিত্র ধরনের, বিচিত্র পেশার মানুষের বাস। তারা সমাজের বিভিন্ন সত্মরের মানুষ, খুঁপড়ির মত একেকটা ঘর, একা মানুষ থেকে বিরাট সংসার নিয়ে বাস করছে কেউ, বাঙালি ছাড়াও অন্য ভাষাভাষীর লোকও বাস করে এখানে। আছে বুড়ো অভিজ্ঞ আহমদ হোসেন, সে কি করে কেউ জানে না, কিন্তু জীবনের সব ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলে সে, যেন সে ত্রিকালদশর্ী। শওকতের কোন চাকরি নেই। মার্থা গ্রাহামের সঙ্গে তার পরিচয় অনেক দিনের হলেও মার্থা স্বামী পরিত্যক্তা, এই মার্থা শওকতকে আশ্রয় দেয়, শওকত বাঁচার রাসত্মা খুঁজে পায়। মার্থা ওষুধের দোকানের চাকরি করে, তারা দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে, আলাদা বাসা ভাড়া নেয়ার কথা ভাবে এমনকি ওষুধের দোকানটা কিনে নেয়ার চিনত্মা করে বাড়তি টাকা রোজগার করতে লেগে যায়, কিন্তু শওকতের সমসত্ম স্বপ্নই ভেঙ্গে যায়, যখন পুলিশ এসে মার্থাকে ধরে দোকান থেকে ওষুধ চুরি করে বাজারে বিক্রি করার অপরাধে। শওকত জানে, সুন্দরভাবে জীবন সাজানোর জন্যই মার্থা এ কাজ করেছে অথচ পৃথিবীর কোন মানুষকে বোঝানো যায় না যে কত বড় সামাজিক অপরাধ করে মানুষ দিব্যি বেঁচে যাচ্ছে, তাদের কোন শাসত্মি হচ্ছে না। শওকত এইসব অসঙ্গতির বিরম্নদ্ধে যেন আর্তচিৎকার করে ওঠে আর সেই ঝড়_বৃষ্টির রাতে মাতাল বউ-মারা কেরানিটার ওপর যেন সমসত্ম আক্রোশ ফেটে পড়ে। দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে, পাশে রাখা একটি দা দিয়ে আঘাত করে মাতালটিকে। এরপর নাচের মেয়ে সেলিনাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যার বস্নাউজের নিচে উদ্ধত যৌবন বহুবার হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। বাঁচার তৃষ্ণায় শওকত সেলিনার হাত ধরে ঝড়-জল আর কুৎসিত কদাকার শহরকে ঠেলে ফেলে ছুটতে থাকে দূরে, বহু দূরে। কিন্তু তারপর? এক সুন্দর বৃষ্টিহীন রোদঝলমলে সকালে কোন অরণ্যের পাশে খড়ের গাদায় শওকতের বুকে মাথা রেখে সেলিনা ঘুমুচ্ছে, তখন_'সহসা গাছের ডালের বুনো পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গেল। মটরশুঁটির ৰেত থেকে একটা সাদা খরগোশের বাচ্চা ছুটে পালিয়ে গেল কাছের অরণ্যের দিকে। খড়ের কোলে জেগে উঠলো অনেক পায়ের ঐকতান। আঠার জোড়া আইনের পা ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়ালো ওদের। ওরা তখনো ঘুমুচ্ছে।' বিচিত্র সব মানুষের সংগ্রামরত জীবনের ছবি, যা মূলত বাঁচারই তৃষ্ণা, এ উপন্যাসে ডিটেলস-এর সাহায্যে তুলে এনেছেন জহির রায়হান।
সাতটি উপন্যাসেই জহির রায়হান সার্থকতার চাবিকাঠি পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন। এরকম জোড়ালো দাবি আলোচকের নেই, কিন্তু যে রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং মানুষের প্রতি তাঁর তীব্র, তীক্ষ্ম ভালবাসা উপন্যাসগুলোর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে আছে, তাকে কোন পাঠকই অস্বীকার করতে পারবেন না। জহির রায়হান কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পাননি, তাঁর চারিত্রিক অস্থিরতা ও আবেগ তাঁকে এ বিষয়ে স্থিত হতে দেয়নি। কেননা তখন তাঁর অনত্মরজুড়ে চলচ্চিত্রের বিশাল ক্যানভাস। উপন্যাস লেখা চলেছে চলচ্চিত্র নির্মাণের ফাঁকে ফাঁকে। তবে এৰেত্রে আশ্চর্য একটি সাদৃশ্য ধরা পড়ে, তাহলো তাঁর উপন্যাস লেখা আর চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় একই সঙ্গে অর্থাৎ ১৯৬০ সাল থেকে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যনত্ম, ধারাবাহিকতায় পূর্ণছেদ কখনো পড়েনি। একথা সত্য, জহির রায়হানের গল্প-উপন্যাস আমাদের কথাসাহিত্যের শাখাকে যে সমৃদ্ধ করেছে এতে সন্দেহ নেই। বিশেষ কালের, বিশেষ সময়ের চিত্র যিনি সাহিত্যে যথাযথ ফুটিয়ে তুলতে পারেন, সমকালীন কথাকে চিরকালীন করতে পারেন, মানুষের সংগ্রামমুখর জীবনের যিনি অনত্মরঙ্গ সঙ্গী হতে পারেন; তিনিই তো মহৎ শিল্পী। জহির রায়হান গল্প-উপন্যাস যা কিছুই লিখেছেন, তাতে কোন কৃত্রিমতা ছিল না। শত প্রতিকূলতায় তিনি হার মানতেন না বলেই তাঁর প্রায় সব লেখাই হয়ে ওঠে সমাজসম্পৃক্ত; ভাল হচ্ছে কিনা, তার চাইতে সমাজকে তিনি কিছু দিতে পারছেন কিনা, এই চিনত্মাই তাঁকে লেখক হওয়ার প্রেরণা যোগায়। তাঁর গল্প-উপন্যাস যদি আমাদের ক্রমশ রাজনীতিসচেতন, সমাজসচেতন, দেশসচেতন, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সচেতন করে তুলতে পারে তাহলেই আমরা আমাদের অসত্মিত্বের শিকড় খুঁজে পাবো। জহির রায়হানের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা তখনই প্রকাশ পাবে।
-------------------------------
আমি খুবি সাধারণ একজন। ভালবাসি বই পড়তে। ভালবাসি ভ্রমণ করতে। Mobile No- 0914139916, 01614139916 afaruque.faruque@gmail.com www.facebook.com/aktar.faruque.ctg
রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০১৭
জহির রায়হানের উপন্যাস -
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
একুশের আক্ষেপানুরাগ
বেশ কয়েক বছর থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারির অঙ্গীকার ছিল অফিস আদালতে শতভাগ বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিদেশী ভাষার ব্যবহার কমানো, ব্যানার, ফেস...

-
আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে ত্রিশোত্তর যুগের কবিদের মধ্যে জীবনান্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) সর্বশ্রেষ্ঠ। মনন, মেধায়, চিন্তা-চেতনায়, চিত্রকল্প রচনা...
-
প্রমথ চৌধুরী বলে ছিলেন, "বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে".... চট্টগ্রামের মানুষ হিসেবে ব্যপারটা আসলেই চিন্তা...
-
"বুঝা" এবং "বোঝা" শব্দ দুইটি নিয়ে আমাদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। আমরা অনেকেই "বুঝা" এর জায়গায় "বোঝা...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন