আমাকে অনেক ছাত্র/ছাত্রী ক্লাসে প্রশ্ন করেন, নজরুল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মেয়ে কিংবা ভাতিজীকে কেন বিয়ে করেছেন? তাদের বলছি নজরুল রবীন্দ্রনাথের মেয়ে বা ভাতিজীকে বিয়ে করেননি। তিনি কুমিল্লার গিরিবালা দেবীর মেয়ে প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করেন। আমি তোমাদের জন্য বিয়ের ইতিহাসটা তুলে ধরলাম।
১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর কবি বহরমপুর জেল হতে মুক্ত হন এবং সরাসরি চলে যান কুমিল্লায়। এ সম্পর্কে নজরুলের বন্ধু খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন লিখেছেন, “মুসলিম জগতে’র তৎকালীন সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের সাথে এ আলোচনায় কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি। কিন্তু কোথায় নজরুল? বহরমপুর জেলে নজরুল আর নেই-সারা কলকাতায় নজরুল নেই। কোথায় তিনি? তাঁর অগনিত ভক্তবৃন্দক একে বারে পথে বসিয়ে তিনি সরে পড়েছেন কুমিল্লায় – এক নিভৃত পল্লীতে”।
নানা ঘটনার পরে ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল নজরুল প্রমীলার বিয়ের দিন ধার্য হয়। নজরুল প্রমীলার বিয়ে খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে অনুষ্ঠিত হয় নি। ছেলে মুসলিম-মেয়ে হিন্দু হওয়ায় অনেক সামাজিক গুঞ্জন ও বাঁধার সৃষ্টি হতে পারে, তাই অনেকটা চুপচাপেই বিয়ে সম্পন্ন হয়। এই উদ্দেশ্যে গিরিবালা দেবীও কন্যা প্রমীলাকে নিয়ে কলকাতা পৌঁছেন। পরিবারের অনেকেই এর বিরুদ্ধে ছিলেন। খোদ বিরজা সুন্দরী দেবীর স্বামী ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত (প্রমীলার চাচা যার বাসায় কুমিল্লায় তারা থাকতেন) এই বিয়েতে মত ছিল না। এমনকি বিয়ের আগে বিরজাসুন্দরী দেবী স্বয়ং কলকাতা এসে গিরিবালা দেবী ও তার কন্যাকে ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু তারা যান নি। বিরজা সুন্দরী দেবীর ছেলে বীরেন্দ্রকুমার পর্যন্ত এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন।
নজরুল প্রমিলার বিয়ের সব অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় সাহিত্যিক মিসেস এম. রহমান (মুছাম্মৎ মাসুদা খাতুন) এর তত্ত্বাবধানে। নজরুল তাকেও মা সম্বোধন করতেন। মিসেস এম. রহমান বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় লিখতেন। নজরুলের “বিষের বাঁশী” কাব্য গ্রন্থটি তাকেই উৎসর্গ করা হয়। নজরুলের অনেক হিন্দু – মুসলমান বন্ধুই বিয়ের কথা জানতেন, কিন্ত বিয়ে কখন, কোথা হচ্ছে তা জানতেন না। বিয়ের আসরে উপস্থিতদের মাঝ থেকে কাজী নিয়োগ করা হয় মৌলভী মঈন্উদ্দীন হোসায়েনকে। আর সাক্ষী ছিলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন। উকিল নিযুক্ত করা হয় মিসেস এম. রহমানের পরিচিত জনৈক আবদুস সালামকে।
বিয়ের প্রথমেই যে সমস্যা বাঁধে তা হল: কোন ধর্মমতে বিয়ে হবে? হিন্দু মতে বিয়ে হতে পারে না। হতে পারে এক সিভিল ম্যারেজ অথবা ইসলাম ধর্মমতে। কিন্তু সিভিল ম্যারেজ আইন অনুযায়ী বর কনে উভয়কে এক স্বীকৃতি দিতে হয় তারা কোন ধর্ম মানেন না। কবি এতে প্রবল আপত্তি জানান। তিনি বলেন, ‘আমি মুসলমান-মুসলমানী রক্ত আমার শিরার শিরায় ধমনীতে ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে, এ আমি অস্বীকার করতে পারব না’। অনেকেই প্রস্তাব দিলেন মেয়েকে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করত। কবি এতেও আপত্তি তুললেন, ‘কারুর কোন ধর্মমত সম্বন্ধে আমার কোন জোড় নেই। ইচ্ছে করে তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে পরেও করতে পারবেন’। সেই সাথে কবি ইতিহাস হতে নানা যুক্তিও উপস্থাপন করেন।
এই বিষয়ে বিয়ের অন্যতম সাক্ষী খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন তার যুগস্রষ্টা নজরুল গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “কবির মত মেনে নিয়ে আমাদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হল যে, আহলে কেতাবিদিগের সংগে ক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে হওয়া ইসলাম আইন মতে অসিদ্ধ নয়। এখন কথা হচ্ছে হিন্দুগন ‘আহলে কিতাব’ কিনা? একলক্ষ চব্বিশ হাজার বা দুইলক্ষ ছত্রিশ হাজার পয়গম্বর পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন। এই সকল পয়গম্বর যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষেও পয়গম্বরের আবির্ভাব অসম্ভব নয়। অতএব, এ বিয়ে হওয়া সম্ভবত আইন মনে অন্যায় হবে না”। শেষে ইসলাম ধর্মমতেই ১০০০ টাকা দেনমোহর ঠিক করে নজরুল-প্রমীলার বিয়ে সম্পন্ন হয়।
নজরুল-প্রমীলার বিয়ের পরেই রক্ষণশীল হিন্দু-মুসলিম গোষ্টি এর পেছনে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। প্রবাসী পত্রিকার ব্রাহ্মগোষ্টি এই উদ্দেশ্যে সাপ্তাহিক ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকাতে হিন্দু-মুসলিম বিয়ের ঘটনার বিরুদ্ধে লেখা শুরু করে। এমনকি প্রবাসী পত্রিকায় নজরুলের কবিতা ছাপাও বন্ধ করে দেয়। এক সময় সবই ঠান্ডা হয়ে যায়। বীরেন্দ্রকুমারও নজরুলের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেন বাকিরাও মেনে নেয়। বিয়ের পর হুগলীতেই বসবাস করতে থাকলেন কবি ও নবপরিণীতা স্ত্রী প্রমীলা শাশুড়ি গিরিবালা দেবীসহ। ১৯৩৮ সালে পক্ষাঘাত গ্রস্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত তাদের সংসার ভালই চলছিল। পক্ষাঘাত গ্রস্থ হবার ২/৩ বছরের মধ্যেই কবির শরীরেও রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই কবি নজরুল ইসলাম চূড়ান্ত ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
অসুস্থ প্রমীলা-নজরুলের পরিবারকে আকঁড়ে ধরেন গিরিবালা দেবী। কিন্তু তখন কিছু অপবাদ ছড়িয়ে পড়ে। লোকে বলাবলি করতে থাকে, ‘নজরুলের অর্থ-সম্পদ গিরিবালা দেবী অসুস্থ নজরুলের সেবায় কাজে না লাগিয়ে, জমিয়ে রাখেন’। এই ক্ষোভে ১৯৪৬ সালের অগাস্ট/সেপ্টেম্বরের দিকে গিরিবালা দেবী কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যান। পথে তিনি প্রমীলা দেবীকে চিঠি লিখে জানান তার জন্য কেউ যেন চিন্তা না করে। এরপর গিরিবালা দেবীর আর কোন খোজই পাওয়া যায়নি।
নানা অভাব-অনটন, সংগ্রাম-সঘাতের মাঝে প্রমীলা দেবী তার সংসার টিকিয়ে রাখেন। ১৯৬২ সালের ৩০ জুন কবিপত্নী প্রমীলাসেনগুপ্ত দীর্ঘ সময় পক্ষাঘাতগ্রস্থ থাকার পরে মৃত্যু বরণ করেন।।
আমি খুবি সাধারণ একজন। ভালবাসি বই পড়তে। ভালবাসি ভ্রমণ করতে। Mobile No- 0914139916, 01614139916 afaruque.faruque@gmail.com www.facebook.com/aktar.faruque.ctg
বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৭
নজরুল ও প্রমিলার বিয়ে-
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
একুশের আক্ষেপানুরাগ
বেশ কয়েক বছর থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারির অঙ্গীকার ছিল অফিস আদালতে শতভাগ বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিদেশী ভাষার ব্যবহার কমানো, ব্যানার, ফেস...

-
আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে ত্রিশোত্তর যুগের কবিদের মধ্যে জীবনান্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) সর্বশ্রেষ্ঠ। মনন, মেধায়, চিন্তা-চেতনায়, চিত্রকল্প রচনা...
-
প্রমথ চৌধুরী বলে ছিলেন, "বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে".... চট্টগ্রামের মানুষ হিসেবে ব্যপারটা আসলেই চিন্তা...
-
"বুঝা" এবং "বোঝা" শব্দ দুইটি নিয়ে আমাদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। আমরা অনেকেই "বুঝা" এর জায়গায় "বোঝা...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন