মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০১৭

জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতি সংলগ্ন কবি।

আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে ত্রিশোত্তর যুগের কবিদের মধ্যে জীবনান্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)  সর্বশ্রেষ্ঠ। মনন, মেধায়, চিন্তা-চেতনায়, চিত্রকল্প রচনায়, আঙ্গিক নির্মাণ পদ্ধতিতে তাঁর কাব্য কবিতা স্বকীয় স্বতন্ত্র ধারা অনুসারী ও বিস্তারী। জীবনানন্দ দাশ সত্যিকার অর্থেই একজন অতি আধুনিক রীতিপ্রবর্তক প্রভাবশালী কবি।  বুদ্ধদেব বসুর মতে- ‘‘জীবনানন্দের অবস্থান রবীন্দ্রনাথের সূর্য মঙ্গলের বাইরে। আধুনিক কবিদের মধ্যে একমাত্র জীবনানন্দরই  নাম করা যেতে পারে যিনি নিজের একটি জগৎ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। সে জগৎ ঈশ্বরের জগতের অনুকরণ নয়, জগতের ব্যাখ্যা নয়, সে জগৎ অনুভূতির আলো ছায়ায় তৈরী চেতনার জগৎ।’’ জীবনানন্দ দাশ বাংলার রূপকথার ছাঁচে গল্প বলার ধারায় কবিতায় লৌকিকতার আমেজ নিয়ে আসেন, আর মানব সভ্যতার ইতিহাস চেতনার সঙ্গে রূপসী বাংলার নিঃসর্গ প্রীতিকে চিত্রিত করেন। যার মূলে ছিল সমাজ বিবর্তনের ঐতিহাসিক বাস্তবতা। আধুনিক কবি হয়েও জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির কবি নামে অভিহিত হয়েছেন।

প্রত্যেক শিল্পী বা সাহিত্যেকের কর্মে প্রকৃতির প্রভাব বা প্রকৃতি চেতনা থাকে। অবশ্য এক হিসেবে সকল কবিই প্রকৃতির কবি, কিন্তু সকল কবিকেই ঐ আখ্যা দেয়া যায় না। কারণ- সকলের পক্ষেই প্রকৃতি প্রধান বিষয় হয় না। অনেক কবির কাছে প্রকৃতি মানব জীবনের নানা অভিজ্ঞতার পটভূমিকা, অনেকের কাছে ইন্দ্রিয়ের বিলাস, অনেকের কাছে প্রেমের উদ্দীপনা ও প্রতিক্রিয়া মাত্র। প্রকৃতিকে অতি নিবিড়ভাবে অনুভব করেন না এমন কোন কবি নেই; কিন্তু সমগ্র জীবনকে প্রকৃতির ভিতর দিয়েই গ্রহণ করেন এমন কবির সংখ্যা অল্প, তারাই বিশেষভাবে প্রকৃতির কবি। মনেহয় আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে একজনকে এ বিশেষ অর্থে প্রকৃতির কবি বলা যায়; যিনি জীবনানন্দ দাশ।

জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতি লালিত কবি। রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’র ঐতিহ্যে বাংলায় দুজন মহৎ শিল্পীর জন্ম হয়েছে। একজন ‘পথের পাঁচালীর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আরেকজন হলেন ‘বনলতা সেনে’র জীবনানন্দ দাশ।’ জীবনানন্দের কবিতার আঙ্গিকরস হলো প্রেমের রসরূপ। আর তাঁর প্রকৃতির কবিতাও প্রেমের রসে জারিত। চোখে প্রেমের মায়াজাল পরেই সৌন্দর্যমুগ্ধ কবি বাংলার প্রকৃতিকে দেখেছেন। সে দেখার মধ্যে এমন একটা কোমল মধুর স্পর্শ আছে যে, অতিতুচ্ছ নগন্য বস্তুও অসামান্য মহিমায় মন্ডিত হয়ে ওঠেছে। যেমন : ঘাস অতিতুচ্ছ বস্তু। কিন্তু কবির অপূর্ব কাব্যিক ব্যঞ্জনার কারণে তা অসাধারণ হয়ে ওঠেছে-
‘‘কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস- তেমনি সুঘ্রাণ-
হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে!
আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে ঘষি,
ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভিতর ঘাস হ’য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার
শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।”    (ঘাস)

জীবনানন্দের প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাগুলো পড়লে বুঝতে পারা যায় জীবনকে তিনি কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন। জীবনানন্দ মানুষকে ভালোবেসেই পেয়েছিলেন প্রকৃতিকে। প্রকৃতির বুকেই তাঁর প্রেমের, তাঁর প্রেমেজ বেদনার মুক্তি। তাইতো দেখা যায় কবি তাঁর মানসী শঙ্খমালাকে খুঁজেছেন নক্ষত্রে, সন্ধ্যার নদীর জলে, জোনাকির দেহে, ধানক্ষেতে, অগ্রাণের অন্ধকারে।
“খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে- খুঁজেছি তোমারে সেইখানে-
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রানের অন্ধকারে ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।”    (শঙ্খমালা)

বনলতা সেন কাব্যে জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি চেতনার পরিচয় সবচেয়ে বেশি নিহিত আছে ‘বনলতা সেন’ কবিতায়। মহাসময়ের সঙ্গে যে মহাজীবনের অনুভব কবি মনে বহন করেছেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান জীবনকে দেখেছেন তিনি এ কবিতায়। এখানে তাঁর প্রিয়াকে আবিষ্কর করেছেন প্রকৃতির মধ্যে। দীর্ঘ ভ্রমনে কবি যখন শ্রান্ত, ক্লান্ত তখন তিনি শান্তি খুঁজে পান নাটোরের বনলতা সেনের কাছে। এ বনলতা সেনের রূপ বর্ণনায় তিনি প্রকৃতির আশ্রয় নিয়েছেন।
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”   (বনলতা সেন)
প্রকৃতি জীবনানন্দের দ্বিতীয় প্রিয়া। নানা রূপে তিনি সেই প্রিয়াকে দেখেছেন। কার্তিকের শস্যভারে নত মাঠের দিকে চেয়ে তিনি দেখেছেন সেই সুন্দরীর প্রকৃত রূপটিকে। আলোক উজ্জ্বল রৌদ্রেও কবি তাঁর প্রিয়াকে খুঁজে পেয়েছেন। কখনো হাঁসের গায়ের ঘ্রাণে তাঁর হারানো প্রেমিকার কথা মনে হয়েছে।
“হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু’একটা কল্পনার হাঁস;
মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;
উড়–ক উড়–ক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়–ক
কল্পনার হাঁস সব-পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেলে পর
উড়–ক উড়–ক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নরা ভিতর।”   (বুনো হাঁস)
প্রকৃতি নিয়ে এমন প্রেমানুভূতির কথা বাংলা কাব্যে আমরা খুব কমই পেয়েছি। বাংলায় মাঠে প্রান্তরে, পাড়াগাঁর গায়ে, রূপশালি ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ আর কোনো কবি পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। এখানেই প্রেমিক কবি বলেছেন- “আমি দেখেছি, আমি পেয়েছি, আমার আর কিছু দেখার নেই, আর কিছু পাবার নেই।”
প্রকৃতিপ্রেমিক কবি তাঁর বনলতা সেন কাব্যে দেখিয়েছেন-  যে প্রকৃতিপুঞ্জের মধ্যে একটি নিটোল পরিপূর্ণতা আছে বর্তমান যুগ তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে রূঢ় হৃদয়হীন যান্ত্রিকতার আঘাতে। এ প্রসঙ্গে ‘শিকার’ কবিতাটি উল্লেখযোগ্য।  এখানে কবি বলেছেন বর্তমান যুগে শিকার করছি আমরা নিজেকেই। জীবনের শান্তি, প্রেম, সৌন্দর্যকে। অথবা কবির মতো অনুভূতিশীল, সুক্ষ, সৌন্দর্যচৈতন্যময় তারাই এ যুগের শিকার। ময়ূরের সবুজ ডানার মতো আলো ঝলমল ভোরে সুন্দর, বাদামী হরিণেরে মৃত্যুও বর্ণনার পরই কবি এমনভাবে শিকারী দলের বর্ণনা করেছেন যে, প্রকৃতির শান্ত সুষমাময় সঙ্গতির মধ্যে বর্তমান যুগকে মনে হয় মূর্তিমান তালভঙ্গ।
“সিগারেটের ধোঁয়া,
টেরিকাটা কয়েকটা মানুষের মাথা
এলোমেলো কয়েকটা বন্দুক-হিম-নিস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।”  (শিকার)
এখানে কবি বুঝাতে চেয়েছেন যে হরিণের মৃত্যু হলো। আর সে তো প্রকৃতপক্ষে প্রাণের হরিণ। ‘আমি যদি হতাম’ কবিতায়ও সৌন্দর্য চেতনার, প্রেমস্পৃহার, সঙ্গতির, সাধনার অপমৃত্যুও কথা বলা হয়েছে। তবে এ কবিতার সুর কিছুটা পৃথক। সৌন্দর্য, প্রেম, পূর্ণতা, এখনো বনহংস অর্থ্যাৎ অন্য প্রাণীর মধ্যে আছে, মানুষের জীবনে তা একেবারেই নেই। বনহংসের জীবনও নষ্ট হয় গুলির আঘাতে কিন্তু সে মৃত্যু আসে অখন্ডরূপে, আর মানুষের জীবনে মৃত্যু আসে টুকরো টুকরো ব্যর্থতায় খন্ডিত হয়ে। এখনো দেখা যায় যুগের সংঘাতে ক্লান্ত কবি বনহংস হয়ে প্রকৃতির বুকে আশ্রয় নিতে চেয়েছেন-
“আমি যদি হতাম বনহংস
বনহংসী হতে যদি তুমি
...................................
তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রূপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম।”   (আমি যদি হতাম)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে জীবনানন্দ দাশ সমগ্র জীবনকে প্রকৃতির ভিতর দিয়ে গ্রহণ ও প্রকাশ করেছেন তাই তিনি প্রকৃতির কবি। প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ তিনি তার কাব্যে তুলে ধরেছেন। আলোচনার পরিসমাপ্তিতে তাই একথা বলা যায় জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির কবি এই অর্থে যে, প্রকৃতিই তাঁর সমস্ত উপলব্ধির রূপক। অবশেষে বলা যায়, জীবনানন্দ দাশের কাব্য চেতনার গভীরে ছিল প্রকৃতির পরিবেশের প্রভাব। প্রকৃতি তাঁর চিন্তার মানস সরোবর। তাঁর জীবনবোধের গভীরে প্রকৃতি চেতনা কর্তৃক এতই প্রবল ছিল যে, তাঁর সমস্ত ভাবনা, চিন্তা, ধ্যান ধারনা ও অনুভব উপলব্ধি, তাঁর জীবন ও কাব্য প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তাই জীবনানন্দ দাশকে প্রকৃতির কবি বললে কোন অসঙ্গত উক্তি করা হয় না। তিনি প্রকৃতির অন্তরঙ্গ রূপের মধ্যে দিয়ে অন্য কোন চিরকালীন রূপের সন্ধান করেছেন। তাই তিনি মৃত্যুর পর ও প্রকৃতিকে ভালোবেসে, প্রকৃতির উপাদান হয়ে, প্রকৃতির মাঝে আবার জন্মাতে চান-
“আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হ’য়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবো-কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলায় নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে।”  (আবার আসিব ফিরে)

লেখক- আখতার ফারুক।
ফোন- ০১৯১৪১৩৯৯১৬/০১৬১৪১৩৯৯১৬
ই-মেইল- afaruque.faruque@gmail.com

1 টি মন্তব্য:

একুশের আক্ষেপানুরাগ

বেশ কয়েক বছর থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারির অঙ্গীকার ছিল অফিস আদালতে শতভাগ বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিদেশী ভাষার ব্যবহার কমানো, ব্যানার, ফেস...