ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ শব্দটি মূলত ইংরেজি সেক্যুলারিজম শব্দের বাংলা অনুবাদ। Secularism-এর অভিধানগত অর্থ হল নৈতিকতা ও শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয় এই মতবাদ (তথ্য সূত্র-Bangla Academy)। লন্ডন থেকে প্রকাশিত কেমব্রিজ ডিকশনারিতে Secularism সম্পর্কে বলা হয়েছে, The believer that religion should not be involved with the ordinary social and political activities of country. অর্থাৎ একটি দেশের সাধারণত সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর প্রভাব থাকবে না এমন একটি ধর্মের বিশ্বাস। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ধর্মীয় প্রবণতা বা ধর্মীয় বিধিবিধান মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ জীবনের সকল শাখা-প্রশাখায় তথা মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ সকল শাখা থেকে আল্লাহ ও রাসূলের বিধান বাদ দেয়ার নামই ধর্মনিরপেক্ষতা। তাই এ মতবাদের উৎপত্তি, প্রকৃত রূপ ও পরিণাম ও বৈধতা সম্পর্কে তথ্য ও যুক্তি ভিত্তিক আলোচনা প্রয়োজন। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি রাষ্ট্রীয় দর্শন। ইউরোপের একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর উদ্ভব। সেই রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সামনে না রেখে শুধু শব্দটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর অর্থ ব্যাখ্যার প্রয়াস গ্রহণ করতে অনেক বই দেখা যাচ্ছে। এমনকি অনেক বিজ্ঞ কলামিস্ট ও আলেম-ওলামা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রদর্শনের তাৎপর্য না বুঝেই এর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত পেশ করছেন। এ ধরনের প্রেক্ষিতে যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দর্শনের উদ্ভব তা আমাদেরও জানা প্রয়োজন। গত ২৫০ বছর থেকে এটা পৃথিবীর সত্য একটি আদর্শের মর্যাদা লাভ করেছে। দার্শনিকদের মধ্যে দান্তে (জন্ম ১২৬৫ মৃত্যু ১৩২১ খ্রি.) তিনি ছিলেন এর অন্যতম প্রবক্তা। তিনি বলেন, মানবজীবনের দুটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাই দুজন পথপ্রদর্শক, দুটি আলোকবর্তিকা শাশ্বত জীবনের শুভ পথ দেখাবেন পোপ ধর্মগ্রন্থের দিব্যাজ্ঞানের মশাল হাতে নিয়ে। আর পার্থিব সুখের পথপ্রদর্শক হবেন স্রষ্টা। তার যৌক্তিক ও দার্শনিক পসরা হাতে নিয়ে। পরবর্তী সময়ে দার্শনিক মরসিলিও (জন্ম ১২৭৪ মৃত্যু ১৩৪৩) এতে চার্চের ওপর রাষ্ট্রে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলেন এবং ধর্মকে জীবনের আজ্ঞিনা থেকে হটিয়ে কেবল পারলৌকিক মুক্তির পরিমন্ডলে আবাদ করলেন। তিনি বলতেন, যাভ্যবাদের মূল কথা হল পরকালের উন্নত জীবনের নিশ্চয়তার আশ্বাস। আর রাষ্ট্রের কাজ হলো উন্নত জীবন সংগঠন এবং তা শুধু ইহকালের নয় পরকালের। আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রদর্শনের জনক বলা হয় যাকে তিনি হলেন ম্যাকিয়াভেলি। তিনি ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইটালির ফ্লোরেন্স নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন ধর্মে অবিশ্বাসী। আমেরিকায় মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে পরিচালিত এ আন্দোলন ‘আপোষ আন্দোলন' নামে খ্যাত। এ আন্দোলনের মূল নীতি হলো ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকুক এবং মানুষের ধর্মীয় দিকের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চার্চের হতে থাকুক। কিন্তু, সমাজের পার্থিব জীবনের সকল কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং পার্থিব কোনো বিষয়ে চার্চের কোনো প্রাধান্য থাকবে না। তবে অবশ্যই রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দকে চার্চের নিকটই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবার সময় শপথ গ্রহণ করতে হবে। এবার আসুন ধর্মনিরপেক্ষতার পরিণাম কি হল? মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম কামাল পাশাই এ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্ক পাশা আধুনিক তুরস্ক গড়ার নামে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফলে এ মতবাদের নিয়ম অনুসারে মসজিদে মাইকে আযান দেয়া, জামায়াতে নামাজ আদায় করা, আরবি ভাষা শিক্ষা করা, কুরআন শরীফ শিক্ষা করা, মাহফিল করা, কুরবানী করা, ঈদের নামায আদায় করা, বোরকা পরা, মাথায় ওড়না পরিধান করাসহ সকল প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ করেও দেয়া হয়েছে। এটাই কি ধর্মীয় ব্যক্তি স্বাধীনতা? এরপর তুরস্কে মুসলিম সরকার ক্ষমতার মসনদে অসীন হয়ে পার্লামেন্টের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অবৈধ ঘোষণা করা হল। পরবর্তীতে কামাল পাশার পৃষ্ঠপোষকধারী ক্ষমতায় এলে মুসলিম প্রেসিডেন্টকে ফাঁসি দেয়া হয়। আর বাংলাদেশের বর্তমান সরকার (২০০৯...) ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নামে ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংবিধানের ৫ম সংশোধনিকে অবৈধ ঘোষণা করে '৭২ সালের সংবিধানের আলোকে সংবিধানের মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আর আমাদের দেশেও ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে তাফসীর মাহফিল ও ধর্মীয় সভা-সমাবেশের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
আর ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান ফ্যাসিবাদ সরকার ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দদের কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে আটকে রেখেছেন। আর এ থেকে বুঝা যায় বাংলাদেশ অচিরেই তুরস্কের ভাগ্যবরণ করবে। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাকালে দেখতে পাই ধর্মনিরপেক্ষতার পরিণাম কী? এবার দেখুন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার আদায়ে বাধা প্রদান করে অথচ আমেরিকার ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ধর্মীয় বিধি বিধান অনুসারে আমেরিকা কংগ্রেসে পোপের হাতে বাইবেল নিয়ে শপথ নিলেন। আর স্বার্থান্বেষী দেশ ভারত কাশ্মীর ও গুজরাটসহ অনেক প্রদেশে মুসলমানদের ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে বাধা দেয়া হয়। উদাহরণ স্বরূপ ভারতে মুসলমানদের কুরবানী দেয়া এবং গরু জবাই করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঈদের নামাজে ঈদগাহে হিংস্র শিকারি কুকুর ও শুকর মুসলমানদের ওপর লেলিয়ে দেয়া হয়। অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং শিখ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় ধর্মীয়সহ সকল রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে মাথায় ধর্মীয় পাগড়ি পরিধান করেন। এমনকি ভারতের পার্লামেন্টেও মাথায় পাগড়ি পরিধান করেন। আর বাংলাদেশের মন্ত্রীবর্গ মন্ত্রীপরিষদে কুরআন নিয়ে শপথ করলে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল (BBC, CNN, The India Times) সমালোচনার ঝড় তোলেন। তখন তারা মৌলবাদের ও জঙ্গিবাদের গন্ধ পান। এর সাথে আমাদের দেশের কিছু বামপন্থী মিডিয়া অপপ্রচার শুরু করে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে তাদের এই দ্বিমুখী নীতির জন্য প্রশ্ন করলে মুসলমানদের ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র ব্যতীত কিছুই পাওয়া যাবে না। আর ধর্মনিরপেক্ষত স্বয়ং কোন আদর্শ নয়, বরং এটা চরম আদর্শহীনতা (Absence of Ideology) ছাড়া আর কিছুই নয়। উদাহরণ স্বরূপ লক্ষ্য করুন আমেরিকার আইন সভায় ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে শাসনতন্ত্রের ১৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে মদ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু, আবার ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে শাসনতন্ত্রের ২১তম সংশোধনীর মাধ্যমে পূর্ববর্তী আইন বাতিল করে মদকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। উভয় সিদ্ধান্তের উদ্দ্যেশই হল জাতির মঙ্গল বিধান। কিন্তু, এই দুই বিপরীত সিদ্ধান্তের বেলায়ই মদের মূল্যমান কোনো সময়ই পরিবর্তিত হয় না। ধর্মকে জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ত্যাগ করার ব্যবস্থা করলে এ চিরন্তন মূল্যমান কোথায় পাওয়া যাবে? সঠিক মূল্যমান নির্ধারণ করতে অক্ষম হলে মানব জীবন যে অবস্থার সম্মুখিন হয় তা আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতিসমূহের মানবতাবোধের মান থেকেই অনুভব করা যায়। ধর্মনিরপেক্ষতা বাদের ফলে মানুষ প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হতে বাধ্য। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চরম অধর্মের পক্ষে ও ধর্মের চরম দুশমন। ধর্মনিরপেক্ষতার আরেক নাম ধর্মহীনতা। আর কোনো মুসলমান ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূলকথা অনুযায়ী ধর্মকে শুধু ব্যক্তিগত জীবনে আবদ্ধ রাখাকে ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ, ইসলামকে বলা হয় ‘Islam is the complete code of life' অর্থাৎ ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আর আল্লাহ বলেন, ‘‘হে মুসলমানগণ তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর, আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না।’’ আল্লাহর কিতাবকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ না করে যারা শুধু ইসলামের কতিপয় অনুষ্ঠান নিয়েই সন্তুষ্ট, তাদের প্রতি কুরআন যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে তা যে কোন সত্যিকার মুসলমানের অন্তরকেই কাঁপিয়ে তুলবার জন্য যথেষ্ঠ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘তোমরা কী কিতাবের কতক অংশের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছ, আর কতক অংশকে অবিশ্বাস কর?’’ যারা এরূপ করে তাদের জন্য এ দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ও অবমাননা ছাড়া আর কী বদলাই বা থাকতে পারে। অতএব তাদেরকে ভয়ঙ্কর শাস্তির দিকে ঠেলে দেয়া হবে। সুতরাং কুরআনের বিধান অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ একটি কুফরী মতবাদ। মানবরচিত ভ্রান্ত বাতিল মতবাদ, ইহার অনুসরণ মুসলমানদের জন্য অবৈধ। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা মূলত রাষ্ট্রীয় দর্শনের নামে মানুষকে ইসলামী মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত করা এবং মুসলমান জাতিকে ধ্বংস করার ইয়াহুদি ও খ্রিস্টান চক্রের গভীর ষড়যন্ত্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন