রবিবার, ৩১ মে, ২০২০

কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাগধারা-

'খোদার খাসি’ - ভাবনাচিন্তাহীন।
আদিখ্যেতা’ -ন্যাকামি।
"ছকড়া নকড়া" -অবহেলা।
‘মাছরাঙার কলঙ্ক’ - অনেক অপরাধীর মধ্য কেবল একজনকে দোষী সাব্যস্ত করা।
“ক-অক্ষর গোমাংস” -অশিক্ষিত ব্যক্তি।
“বুদ্ধির ঢেঁকি” -নিরেট মূর্খ।
'ধর্মের ষাঁড়' -স্বার্থপর।
"বাঘের মাসি" -নির্ভীক।
“হাত ভারি” -কৃপণ।
“হাত জুড়ানো” -স্বস্তি লাভ করা।
"ঢাকের কাঠি" - -তোষামুদে।
"চোরের সাক্ষী গাঁট কাটা’- সামান্য কাজের সামান্য পাত্র।
‘ঊনকোটি চৌষট্টি’ -প্রায় সম্পুর্ণ।
‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’ -বাপের চেয়ে ছেলের তেজ বেশি।
'ঢাক ঢাক গুড় গুড়'-গোপন রাখার চেষ্টা
'ঢেঁকির কচকচি' -বিরক্তিকর কথা।
'ঢাকের কাঠি' -চাটুকার।
'ঢি ঢি পড়া' বকলঙ্ক প্রচার হওয়া।
'ঢাকের বাঁয়া' -অপ্রয়োজনীয়।
'ঢিমে তেতালা' -মন্থর।
'ভূশণ্ডির কাক' -দীর্ঘজীবী।
'বামনের গরু' -অল্প পারিশ্রমিকে বেশি কাজ করা।
'বার মাস ত্রিশ দিন' -প্রতিদিন।
'নোনা জল ঢোকানো' -নিজেই নিজের ক্ষতি বা বিপদ ডেকে আনা।
'আলুর দোষ' -প্রেমে নাছড়বান্ধা বা প্রেমে প্রবল আকর্ষণ।
'নেপোই মারে দই' -ধূর্ত লোকের ফলপ্রাপ্তি।
"অজগর বৃত্তি" -আলসেমি।
'ত্রিশঙ্কুদশা' -দুটানা অবস্থা।
"জুতো সেলায় থেকে চণ্ডীপাঠ" -ছোট বড় যাবতীয় কাজ করা।
'কচুবনের কালাচাঁদ' - অপদার্থ
'ভিটায় ঘুঘু চড়ানো' - সর্বস্বান্ত করা।
'তাল ঠেকা' - সগর্ব উক্তি।
'পায়াভারি' - অহংকার।
'হাতে দূর্বা গজানো' -আলসেমির লক্ষন।
'সাপের পাঁচ পা দেখা' - অহংকারে অসম্ভবকে সম্ভব মনে করা।
'শিকায় তোলা' -মূলতবি রাখা।
'উলুখাগড়া' -তুচ্ছ ব্যক্তি।
'ঢাক গুড়গুড়' - লুকোচুরি।
'রাবণের চিতা'- চির অশান্তি।
'চাঁদের হাট' - প্রিয়জন সমাগম।
'সাক্ষী গোপাল'- নিষ্ক্রিয় দর্শক।
'চোখের বালি' - অপ্রিয় ব্যক্তি।
'দুধের মাছি' - সুসময়ের বন্ধু।
'নিরানব্বইয়ের ধাক্কা' - সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি।

রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

সব কিছু নষ্টদের দখলে-

তিনি মারা গেলেন সকাল আটটায়.....

আগের রাতে শেরাটনে 'ধর্মীয় গোঁড়ামি অপসারণে মুক্তচিন্তার ভূমিকা' শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রেখেছিলেন। বলেছিলেন, এদেশে উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা ইসলাম।  কাঠমোল্লাদের জন্যই দেশ আজো কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত। অনেক বছর আগেই আমি ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সরে এসেছি। 

সকাল নটায় তাকে পাওয়া গেলো তার বেডরুমে, মৃত।
১০ টার খবরে প্রচার হলো তার মৃত্যুসংবাদ। সাড়া পড়ে গেলো বামপাড়া ও রামপাড়ায়।

তার ইস্কাটনের বাসায় এলেন বুদ্ধিজীবীরা। ড্রয়িংরুমে বড় করে বাঁধানো তার হাস্যোজ্জ্বল ছবির নিচে বসে সাক্ষাতকার দিলেন তারা। তারা জানালেন, দেশ আজ আপোষহীন এক মুক্তমনা যোদ্ধাকে হারিয়েছে। চুরুট টানতে টানতে একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক বললেন, তিনি ধর্ম ও ধার্মিকতার সকল কুসংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন। দেশের উন্নতির জন্য আমাদেরও সে পথে হাঁটতে হবে। করতালিতে চাপা পড়ে গেল অধ্যাপকের কথা, সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্লাশ প্রতিফলিত হলো তার মোটা ফ্রেমের চশমায়।

তার মৃত্যুতে শোকাহত হলেন অনেকেই, ইউরোপ থেকে দুজন ব্লগার টুইটারে শোকবার্তা লিখলেন। কলকাতার বুদ্ধিজীবিরাও সাক্ষাতকার দিতে ছুটলেন আনন্দবাজারের অফিসে।
ঘুরে ফিরে একই কথা বললেন সবাই, তিনি ছিলেন এক জ্ঞানসাধক। জ্ঞানের রাজ্যে ছিল তার অবাধ বিচরণ।

দুষ্টলোকরা অবশ্য উসকানি দিয়ে বললো, যে জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সে তার রবকে চিনতে পারেনি, সেই জ্ঞান কোনো জ্ঞানই  নয়।
-
গোসল ও কাফন পরানো শেষে লাশ নিয়ে আসা হলো শহীদ মিনারে। ফুল দিয়ে কফিনকে বরন করে নিল সবাই। সবকটা চ্যানেলে একযোগে দেখালো সে দৃশ্য।

শহীদ মিনারে রাখা তার লাশের কফিন। শরীরে সাদা কাফন পড়ানো। বুদ্ধিজীবীরা ফুল দিয়ে গেল। কেউ কোনো  প্রতিবাদ জানালো না। কেউ বললো না, খুলে ফেলো কাফনের কাপড়, কারণ 'অসাম্প্রদায়িক' শরীরে 'সাম্প্রদায়িক' পোষাক মানায় না।
জানাজা হলো শেষ বিকেলে। সরকারি মসজিদের এক ইমাম চাকরি বাঁচাতে জানাজা পড়াতে রাজি হলেন। বেচারার মুখটা ছিল ফ্যাকাশে, বাধ্য না হলে হয়তো কাজটা করতো না সে।

জানাজায় যারা এলো, কারোই অজু ছিলো না। দুয়েকজন অবশ্য সতর্কতা হিসেবে দুই হাত পানিতে চুবিয়ে নিল। পেছনের কাতারে দুয়েকজন হিন্দু দাদাও ছিল। সর্বধর্ম বলে একটা কথা আছে কত্তা, এই বলে হে হে করে হাসলেন তারা। জানাজার দৃশ্যটা অদ্ভুত দেখালো, কেউ কেউ ডান হাতের উপর বাম হাত বেধে উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলেন আসমানের দিকে, কেউ লাইভ প্রচার করা ক্যামেরাগুলোর দিকে, বুদ্ধিমানরা অত ঝামেলায় গেলেন না, দু’হাত খুলে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনেই ব্যস্ত হলেন।

জানাজা শেষে, লাশ এলো বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে। জীবনে যাদের সাথে ছিলেন, মরনেও তাদের সাথে রাখার সুন্দর ব্যবস্থা আছে এখানে। দুষ্টলোকরা অবশ্য বলে, আজাবের ফেরেশতার সুবিধা হয় এতে। পালের গোদা সবগুলোকে একসাথে পাওয়া যায় এখানে।

মাটিতে নামানো হলো লাশ। সম্মান দেখিয়ে একুশবার ফাঁকা গুলির শব্দ করা হলো। ভয়ে পেয়ে দুটো ঘুঘো গাছের ডাল ছেড়ে উড়াল দিলো। কেউ একজন অশুদ্ধ উচ্চারণে পড়লেন, বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ। এভাবে মৃত ব্যক্তিটির সাথে চরম গাদ্দারি করলো তার জীবিত বন্ধুরা।

লাশ রাখা শেষে মাটি চাপা দেয়া হল।
সারা জীবন কটাক্ষ করেছেন ধর্মকে, শত্রু ছিলেন ধর্মীয় শিক্ষার। ভালো লাগেনি মদীনার নবীর কথা।

কিন্তু এখন, মদীনার নবীর শেখানো পদ্ধতিতে, যাত্রা করলেন অসীম অনন্তে। অবাক করা ব্যাপার হলো, তার বন্ধু ও সহকর্মীদের মনেও এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন দেখা দিল না। তারাও ধরে নিয়েছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক কিছু।

সেদিন সন্ধ্যায় তার বিলাসবহুল বাড়ির সামনে জ্বালানো হলো ৮৪ টি মোমবাতি।

৮৪ বছর বেঁচে ছিলেন একথা বুঝাতে। দুষ্টলোকরা অবশ্য বললো, ‘কবরে আগুন জ্বলছে, তাই বারান্দায় ঝোলানো তার ছবির নিচেও মোমবাতির আগুন’।

একথা শুনে সদ্য করোনা থেকে ফিরে আসা এক অধ্যাপক বিরস বদনে বললেন, হুহ, একদিন সবকিছু নষ্টদের দখলে যাবে।

বৃহস্পতিবার, ১৪ মে, ২০২০

নজরুলের ইসলামি সংগীত।

শ্যামা সঙ্গীতের রেকর্ডিং শেষে কাজী নজরুল ইসলাম বাড়ি ফিরছেন। যাত্রাপথে তাঁর পথ আগলে ধরেন সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীন। একটা আবদার নিয়ে এসেছেন তিনি। আবদারটি না শোনা পর্যন্ত নজরুলকে তিনি এগুতে দিবেন না।

আব্বাস উদ্দীন নজরুলকে সম্মান করেন, সমীহ করে চলেন। নজরুলকে তিনি ‘কাজীদা’ বলে ডাকেন। নজরুল বললেন, “বলে ফেলো তোমার আবদার।”

আব্বাস উদ্দীন সুযোগটা পেয়ে গেলেন। বললেন, “কাজীদা, একটা কথা আপনাকে বলবো বলবো ভাবছি। দেখুন না, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা কী সুন্দর উর্দু কাওয়ালী গায়। শুনেছি এদের গান অসম্ভব রকমের বিক্রি হয়। বাংলায় ইসলামি গান তো তেমন নেই। বাংলায় ইসলামি গান গেলে হয় না? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আপনার জয়গান হবে।”

বাজারে তখন ট্রেন্ড চলছিলো শ্যামা সঙ্গীতের। শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে সবাই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে। এই স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক মুসলিম শিল্পী হিন্দু নাম ধারণ করেন। মুনশী মোহাম্মদ কাসেম হয়ে যান ‘কে. মল্লিক’, তালাত মাহমুদ হয়ে যান ‘তপন কুমার’। মুসলিম নামে হিন্দু সঙ্গীত গাইলে গান চলবে না। নজরুল নিজেও শ্যামা সঙ্গীত লেখেন, সুর দেন।

গানের বাজারের যখন এই অবস্থা তখন আব্বাস উদ্দীনের এমন আবদারের জবাবে নজরুল কী উত্তর দেবেন? ‘ইসলাম’ শব্দটার সাথে তো তাঁর কতো আবেগ মিশে আছে। ছোটবেলায় মক্তবে পড়েছেন, কুর’আন শিখেছেন এমনকি তাঁর নিজের নামের সাথেও তো ‘ইসলাম’ আছে।

আব্বাস উদ্দীনকে তো এই মুহূর্তে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বলা যাচ্ছে না। স্রোতের বিপরীতে সুর মেলানো চট্টিখানি কথা না। আবেগে গা ভাসালে চলবে না। গান রেকর্ড করতে হলে তো বিনিয়োগ করতে হবে, সরঞ্জাম লাগবে। এগুলোর জন্য আবার ভগবতী বাবুর কাছে যেতে হবে। ভগবতী বাবু হলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইন-চার্জ।

নজরুল বললেন, “আগে দেখো ভগবতী বাবুকে রাজী করাতে পারো কিনা।” আব্বাস উদ্দীন ভাবলেন, এইতো, কাজীদার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেলাম, ভগবতী বাবুকে কিভাবে রাজী করাতে হয় সেটা এখন দেখবেন।

গ্রামোফোনের রিহার্সেল-ইন-চার্জ ভগবতী বাবুর কাছে গিয়ে আব্বাস উদ্দীন অনুরোধ করলেন। কিন্তু, ভগবতী বাবু ঝুঁকি নিতে রাজী না। মার্কেট ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে পারে। আব্বাস উদ্দীন খান যতোই তাঁকে অনুরোধ করছেন, ততোই তিনি বেঁকে বসছেন। ঐদিকে আব্বাস উদ্দীনও নাছোড়বান্দা। এতো বড় সুরকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভগবতী বাবুর পিছু ছাড়ছেন না। অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। দীর্ঘ ছয়মাস চললো অনুরোধ প্রয়াস। এ যেন পাথরে ফুল ফুটানোর আপ্রাণ চেষ্টা!

একদিন ভগবতী বাবুকে ফুরফুরে মেজাজে দেখে আব্বাস উদ্দীন বললেন, “একবার এক্সপেরিমেন্ট করে দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় তাহলে আর নেবেন না। ক্ষতি কী?” ভগবতী বাবু আর কতো ‘না’ বলবেন। এবার হেসে বললেন, “নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি। আচ্ছা যান, করা যাবে। গান নিয়ে আসুন।” আব্বাস উদ্দীনের খুশিতে চোখে পানি আসার উপক্রম! যাক, সবাই রাজী। এবার একটা গান নিয়ে আসতে হবে।

নজরুল চা আর পান পছন্দ করেন। এক ঠোঙা পান আর চা নিয়ে আব্বাস উদ্দীন নজরুলের রুমে গেলেন। পান মুখে নজরুল খাতা কলম হাতে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে পড়লেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আব্বাস উদ্দীন খান অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের মতো সময় যেন থমকে আছে। সময় কাটানোর জন্য আব্বাস উদ্দীন পায়চারী করতে লাগলেন।

প্রায় আধ ঘন্টা কেটে গেলো। বন্ধ দরজা খুলে নজরুল বের হলেন। পানের পিক ফেলে আব্বাস উদ্দীনের হাতে একটা কাগজ দিলেন। এই কাগজ তাঁর আধ ঘন্টার সাধনা। আব্বাস উদ্দীন খানের ছয় মাসের পরিশ্রমের ফল।

আব্বাস উদ্দীন খান কাগজটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেনঃ-

“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।”

আব্বাস উদ্দীনের চোখ পানিতে ছলছল করছে। একটা গানের জন্য কতো কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। সেই গানটি এখন তাঁর হাতের মুঠোয়। তিনি কি জানতেন, তাঁর হাতে বন্দী গানটি একদিন বাংলার ইথারে ইথারে পৌঁছে যাবে? ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে টিভিতে ভেজে উঠবে- ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...?

...

দুই মাস পর রোজার ঈদ। গান লেখার চারদিনের মধ্যে গানের রেকর্ডিং শুরু হয়ে গেলো। আব্বাস উদ্দীন খান জীবনে এর আগে কখনো ইসলামি গান রেকর্ড করেননি। গানটি তাঁর মুখস্তও হয়নি এখনো। গানটা চলবে কিনা এই নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানি শঙ্কায় আছে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম বেশ এক্সাইটেড। কিভাবে সুর দিতে হবে দেখিয়ে দিলেন।

হারমোনিয়ামের উপর আব্বাস উদ্দীনের চোখ বরাবর কাগজটি ধরে রাখলেন কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই। সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের বিখ্যাত কণ্ঠ থেকে বের হলো- “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...”। ঈদের সময় গানের এ্যালবাম বাজারে আসবে। আপাতত সবাই ঈদের ছুটিতে।

রমজানের রোজার পর ঈদ এলো। আব্বাস উদ্দীন বাড়িতে ঈদ কাটালেন। কখন কলকাতায় যাবেন এই চিন্তায় তাঁর তর সইছে না। গানের কী অবস্থা তিনি জানেন না। তাড়াতাড়ি ছুটি কাটিয়ে কলকাতায় ফিরলেন।

ঈদের ছুটির পর প্রথমবারের মতো অফিসে যাচ্ছেন। ট্রামে চড়ে অফিসের পথে যতো এগুচ্ছেন, বুকটা ততো ধ্বকধ্বক ধ্বকধ্বক করছে। অফিসে গিয়ে কী দেখবেন? গানটা ফ্লপ হয়েছে? গানটা যদি ফ্লপ হয় তাহলে তো আর জীবনেও ইসলামি গানের কথা ভগবতী বাবুকে বলতে পারবেন না। ভগবতী বাবু কেন, কোনো গ্রামোফোন কোম্পানি আর রিস্ক নিতে রাজী হবে না। সুযোগ একবারই আসে।

আব্বাস উদ্দীন যখন এই চিন্তায় মগ্ন, তখন পাশে বসা এক যুবক গুনগুনিয়ে গাওয়া শুরু করলো- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। এই যুবক গানটি কোথায় শুনলো? নাকি আব্বাস উদ্দীন খান ভুল শুনছেন?

না তো। তিনি আবারো শুনলেন যুবকটি ঐ গানই গাচ্ছে। এবার তাঁর মনের মধ্যে এক শীতল বাতাস বয়ে গেলো। অফিস ফিরে বিকেলে যখন গড়ের মাঠে গেলেন তখন আরেকটা দৃশ্য দেখে এবার দ্বিগুণ অবাক হলেন। কয়েকটা ছেলে দলবেঁধে মাঠে বসে আছে। তারমধ্য থেকে একটা ছেলে গেয়ে উঠলো- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। আব্বাস উদ্দীন এতো আনন্দ একা সইতে পারলেন না। তাঁর সুখব্যথা হচ্ছে।

ছুটে চললেন নজরুলের কাছে। গিয়ে দেখলেন নজরুল দাবা খেলছেন। তিনি দাবা খেলা শুরু করলে দুনিয়া ভুলে যান। আশেপাশে কী হচ্ছে তার কোনো খেয়াল থাকে না। অথচ আজ আব্বাস উদ্দীনের গলার স্বর শুনার সাথে সাথে নজরুল দাবা খেলা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। নজরুল বললেন, “আব্বাস, তোমার গান কী যে হিট হয়েছে!”

অল্প কয়দিনের মধ্যেই গানটির হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়। ভগবতী বাবুও দারুণ খুশি। একসময় তিনি ইসলামি সঙ্গীতের প্রস্তাবে একবাক্যে ‘না’ বলে দিয়েছিলেন, আজ তিনিই নজরুল-আব্বাসকে বলছেন, “এবার আরো কয়েকটি ইসলামি গান গাও না!” শুরু হলো নজরুলের রচনায় আর আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামি গানের জাগরণ।

বাজারে এবার নতুন ট্রেন্ড শুরু হলো ইসলামি সঙ্গীতের। এই ট্রেন্ড শুধু মুসলমানকেই স্পর্শ করেনি, স্পর্শ করেছে হিন্দু শিল্পীদেরও।

একসময় মুসলিম শিল্পীরা শ্যামা সঙ্গীত গাইবার জন্য নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রাখতেন। এবার হিন্দু শিল্পীরা ইসলামি সঙ্গীত গাবার জন্য মুসলিম নাম রাখা শুরু করলেন। ধীরেন দাস হয়ে যান গণি মিয়া, চিত্ত রায় হয়ে যান দেলোয়ার হোসেন, গিরিন চক্রবর্তী হয়ে যান সোনা মিয়া, হরিমতি হয়ে যান সাকিনা বেগম, সীতা দেবী হয়ে যান দুলি বিবি, ঊষারাণী হয়ে যান রওশন আরা বেগম।

তবে বিখ্যাত অনেক হিন্দু শিল্পী স্ব-নামেও নজরুলের ইসলামি সঙ্গীত গেয়েছেন। যেমনঃ অজয় রায়, ড. অনুপ ঘোষল, আশা ভোঁসলে, মনোময় ভট্টাচার্য, রাঘব চট্টোপাধ্যায়।

দুই.

কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি গান লেখার সহজাত প্রতিভা ছিলো। খাতা কলম দিয়ে যদি কেউ বলতো, একটা গান লিখুন, তিনি লিখে ফেলতেন।

একদিন আব্বাস উদ্দীন নজরুলের বাড়িতে গেলেন। নজরুল তখন কী একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আব্বাস উদ্দীনকে হাতের ইশারায় বসতে বলে আবার লেখা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে যুহরের আযান মসজিদ থেকে ভেসে আসলো। আব্বাস উদ্দীন বললেন, “আমি নামাজ পড়বো। আর শুনুন কাজীদা, আপনার কাছে একটা গজলের জন্য আসছি।”

কবি শিল্পীকে একটা পরিস্কার জায়নামাজ দিয়ে বললেন, “আগে নামাজটা পড়ে নিন।” আব্বাস উদ্দীন নামাজ পড়তে লাগলেন আর নজরুল খাতার মধ্যে কলম চালাতে শুরু করলেন।

আব্বাস উদ্দীনের নামাজ শেষ হলে নজরুল তাঁর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এই নিন আপনার গজল!” হাতে কাগজটি নিয়ে তো আব্বাস উদ্দীনের চক্ষু চড়কগাছ। এই অল্প সময়ের মধ্যে নজরুল গজল লিখে ফেলছেন? তা-ও আবার তাঁর নামাজ পড়ার দৃশ্যপট নিয়ে?

“হে নামাজী! আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ,
দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ।”

তিন.

কাজী নজরুল ইসলাম বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর রচিত নাতে রাসূলের জন্য।

১। ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়
আয় রে সাগর আকাশ-বাতাস দেখবি যদি আয়’

২। ‘মুহাম্মদ নাম জপেছিলি, বুলবুলি তুই আগে,
তাই কি রে তোর কন্ঠের গান, এমন মধুর লাগে।'

৩। ‘আমি যদি আরব হতাম মদীনারই পথ
আমার বুকে হেঁটে যেতেন, নূরনবী হজরত’

৪। ‘হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে যায়।
সে যে আমার কামলিওয়ালা, কামলিওয়ালা।’

..

গানগুলো ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। গানগুলো রচনার প্রায় নব্বই বছর হয়ে গেছে। আজও মানুষ গুনগুনিয়ে গানগুলো গায়।

বাংলায় ইসলামি গানের যে নবজাগরণ নজরুল সূচনা করেছিলেন, যে পথ দেখিয়েছেন, পরবর্তীতে সেই পথের পথিক হয়েছেন জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, গোলাম মুহাম্মদ, মতিউর রহমান মল্লিক এবং হাল আমলের কবি মুহিব খান।

তথ্য উৎসঃ

১। আব্বাসউদ্দীনের আত্মজীবনী - ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা'।

২। Roar Media, বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম।

৩। যুগান্তর, 'নজরুল এবং ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে', শামস আরেফিন।

৪। যুগান্তর, 'হামদ-নাতে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন নজরুল', আদিল মাহমুদ।

৫। Risingbd, সুরের আকাশে উজ্জল নক্ষত্র আব্বাসউদ্দীন।

৬। সিলেট টুডে টুয়েন্টি-ফোর, মানবতাবাদী নজরুল থেকে ইসলামি কবি বিলকুল।
সংগৃহীত -
লিখেছেনঃ আরিফুল ইসলাম।

মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০২০

বাংলা সাহিত্যের  জনপ্রিয় কবিতার লাইনগুলি

বাংলা সাহিত্যের  জনপ্রিয় কবিতার লাইনগুলি বা পংক্তিগুলি। এখানে এমন কিছু কালজয়ী কবিতার পংক্তি আছে যা যুগে যুগে মানুষকে আনন্দ দিয়ে গেছে। চিন্তার খোরাক যুগিয়ে গেছে।একটি কবিতা বা একজন কবির অমর হওয়ার জন্য কবিতার গোটা বিশেক লাইন কিংবা কবির অনেকগুলো অনন্য কবিতার প্রয়োজন নেই  বরং একটি-দুইটি লাইন, কবিতা সেই সাথে তার কবিকে দিতে পারে অমরত্ব।তেমন কিছু লাইন আপনাদের জন্য তুলে ধরলাম ...... আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে ...
তাছাড়া বিসিএস , ব্যাংক ও যে কোন প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার জন্যও উপকারে আসবে  ...।
নোটঃ বড় পোস্ট গুলো বই বা ডকুমেন্ট আকারে ডাউনলোড করতে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন ... এবং ইচ্ছামত বই ডাউনলোড করুন এবং নিজের ডকুমেন্টও পাবলিশ করুন ...

কাজী নজরুল ইসলাম
▃▃▃▃▃▃▃
মানুষ
--------------
গাহি সাম্যের গান—
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান

সাম্যবাদী
-------------
সাম্যের গান--
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান ।
গাহি সাম্যের গান !মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই ।

বিদ্রোহী
-------------
বল বীর —
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর !
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর !
বল বীর —
আমি চির উন্নত শির।

নারী
-------------
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
--------------------------
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে -
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে -
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

চল চল চল
-------------
চল চল চল!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণি তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।

জসীমউদ্দীন
▃▃▃▃▃▃▃
কবর
-------------
এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

পল্লী-বর্ষা
-------------
আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!

পল্লীবর্ষা
-------------
আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।

জীবনানন্দ দাশ
▃▃▃▃▃▃▃
বনলতা সেন
-------------
হাজার বছর ধ'রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্তু প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

আবার আসিব ফিরে
--------------------------
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়;

হায় চিল
-------------
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!

অদ্ভুত আঁধার এক
--------------------------
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

আকাশ লীনা
-------------
সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে:
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে:

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে:
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার:
দূর থেকে দুরে-আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে?-তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস-
আকাশের ওপারে আকাশ।

আট বছর আগে একদিন
--------------------------
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ।

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
---------------------------------------
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর :

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
▃▃▃▃▃▃▃
১৪০০ সাল
-------------
আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে—
আজি হতে শতবর্ষ পরে।

স্ফুলিঙ্গ
-------------
বহু দিন ধ'রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।

চার অধ্যায়
-------------
প্রহরশেষের আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম
আমার সর্বনাশ

-------------
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝর-ঝর,
আউশের খেত জলে ভর-ভর,
কালী-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ্‌ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।

দুই বিঘা জমি
-------------
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, "বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।'
কহিলাম আমি, "তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।'

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
--------------------------
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি

সুকান্ত ভট্টাচার্য
▃▃▃▃▃▃▃
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা-
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুদার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি।
--হে মহাজীবন

যে শিশু ভুমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম :
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে ।
-----ছাড়পত্র

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান,
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের ।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি--
নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ।
-------ছাড়পত্র

সাবাশ বাংলাদেশ,
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।।
-----দুর্মর

অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
----অনুভবন

তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে,
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
------প্রিয়তমাসু

অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হবো ইতিহাস ।
----ছাড়পত্র

অন্নদাশঙ্কর রায়
▃▃▃▃▃▃▃
খুকু ও খোকা
--------------------------
তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
বাঙলা ভেঙে ভাগ করো!
তার বেলা?

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
---------------------------------------
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল

আবুল হাসান
▃▃▃▃▃▃▃
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি
---------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেপ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !

আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
সচ্চরিত্র ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখতে যাই, দেখি
কলম খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে, বিষের পুতুল !

নিঃসঙ্গতা
-------------
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!

উচ্চারণগুলি
-------------
লক্ষি বউটিকে
আমি আজ আর কোথাও দেখিনা,
হাটি হাটি শিশুটিকে
কোথাও দেখিনা,
কতগুলি রাজহাঁস দেখি
নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি,

কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখিনা
শিশুটিকে কোথাও দেখিনা !

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
▃▃▃▃▃▃▃
ধনধান্য পুষ্পভরা
--------------------------
ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা;
তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা;
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে- আমার জন্মভূমি।

নির্মলেন্দু গুন
▃▃▃▃▃▃▃
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।

যাত্রা ভঙ্গ
-------------
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে...
মন বাড়িয়ে ছুঁই.....
দুইকে আমি এক করি না....
এক কে করি দুই...!!!!

হেমের মাঝে শুই না যবে...
প্রেমের মাঝে শুই...
তুই কেমন করে যাবি ????
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া....
আমাকেই তুই পাবি...!!!

পুর্ণেন্দু পত্রী
▃▃▃▃▃▃▃
কথোপকথন
-------------
যে কোন একটা ফুলের নাম বল
- দুঃখ ।
- যে কোন একটা নদীর নাম বল
- বেদনা ।
- যে কোন একটা গাছের নাম বল
- দীর্ঘশ্বাস ।
- যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল
- অশ্রু ।
- এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।

প্রতুল মুখোপাধ্যায়
▃▃▃▃▃▃▃
আমি বাংলায় গান গাই
--------------------------
আমি বাংলায় গান গাই।
আমি বাংলার গান গাই।
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুজে পাই।
আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন।
আমি বাংলায় বাঁধি সুর।
আমি এই বাংলার মায়া ভরা পথে হেঁটেছি এতোটা দূর।

ফররুখ আহমদ
▃▃▃▃▃▃▃
পাঞ্জেরি
-------------
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।

রফিক আজাদ
▃▃▃▃▃▃▃
ভাত দে হারামজাদা
--------------------------
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা নদীনালা
গ্রামগঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী
আমার ক্ষুধার কাছেই কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা
তা না হলে মানচিত্র খাব

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
▃▃▃▃▃▃▃
বাতাসে লাশের গন্ধ
--------------------------
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়
▃▃▃▃▃▃▃
অবনী বাড়ি আছো?
--------------------------
অবনী বাড়ি আছো?
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
অবনী বাড়ি আছো?

শহীদ কাদরী
▃▃▃▃▃▃▃
তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা
---------------------------------------
ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।

হন্তারকদের প্রতি
--------------------------
অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলা মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা
---------------------------------------
ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।

©®ইন্টারনেট থেকে

একুশের আক্ষেপানুরাগ

বেশ কয়েক বছর থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারির অঙ্গীকার ছিল অফিস আদালতে শতভাগ বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিদেশী ভাষার ব্যবহার কমানো, ব্যানার, ফেস...