বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০২০

বাগধারা, প্রবাদ, প্রবচন ও খনাযোগ। আজিজ কাজল।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের অনেক প্রবাদ প্রবচনে সেই সময়ের পরিবেশ, প্রকৃতি, চিন্তা, আবহ, যাপন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিছু বাক্যের অর্থ অনুমান নির্ভর। যা আইডিয়া দিয়ে বুঝে নিতে হয়। কিছু প্রবাদ প্রবচনে বাক্যের শব্দ চয়ন অনেক পুরনো। এই প্রযুক্তি-যুগে আমরা এমন বাক্যে (প্রবাদ প্রবচনে) সমার্থক শব্দ বা সিনোনিম ব্যবহার করি। কিছু প্রবাদ প্রবচনের (বইতে আছে) ব্যবহার বর্তমানে খুবই কম। আবার কিছু প্রবাদ প্রবচন পড়লে মনে হবে ঠিক এই সময়ে লেখা।। অথচ উল্লেখিত শব্দের বিকল্প সমার্থক (সিনোনিম) ব্যবহার করে এই আধুনিক বা প্রযুক্তি-যুগেও তা কতো প্রাসঙ্গিক। যেমন’ ‘আপনা মাংশে হরিণা বৈরি’। ভুসুকু পা’র বিখ্যাত এই (ভুসুকুপা রচিত পদ: ৬ এর পঙক্তি) পঙক্তি প্রবাদের মর্যাদায় অনবদ্য। সান্ধ্য ভাষা হয়েও চর্যাপদের বিশেষত্বের কারণে এটি আলাদা মাহাত্ম্য পেয়েছে। এছাড়াও মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র’র লেখা যেমন— ‘কড়িতে বাঘের দুধ মেলে’। এই কড়ির জায়গায় এখন টাকা শব্দটির ব্যবহার আছে। অর্থাৎ টাকা তে বাঘের দুধ মেলে অথবা টাকা দিলে বাঘের চোখ মেলে এমন ব্যবহার খুবই প্রচলিত। আরো যেমন—
‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী’ কাশিরাম দাস।
‘জামাতা ভাগিনা যম আপনার নয়’ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? - ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর।
‘পিপীলিকার পাখা হয় মরিবার তরে’ - কবি কঙ্কন চণ্ডী।

কিছু পার্থক্য নিরুপন করলেও প্রবাদের সাথে (প্রবচন প্রবচন) প্রবচন শব্দটা লাগানো আছেই। বইতে (শাস্ত্রে) এভাবেই পাঠ্য হচ্ছে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ’র ধারণা দিয়ে তা আরেকটু পরিষ্কার করা যায়। তিনি বলছেন—‘প্রবাদের মধ্যে একটা গল্পের আভাস থাকে। কিন্তু প্রবচন হচ্ছে ছাঁটা-কাটা কথা’।

🔲 পশ্চিমা মতে প্রবাদ ও প্রবচন:
প্রবাদ ও প্রবচন বিষয়ে আরেকটু সংক্ষেপ আলোচনায়—এ বিষয়ে পশ্চিমী ধারণা কী বলে? তা জানলে প্রবাদ ও প্রবচন বিষয়ে টোটাল বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা যাবে। ইংরেজিতে অ্যাফরিজম (Aphorism), ম্যাক্সিম (Maxim), পঁসে (Pensee), সেন্টেনশিয়া (Sententia) প্রবাদ (Proverb) এই শব্দগুলোর পারস্পরিক কিছু অন্তর্গত মিল অমিল ও সংযোগ তৈরি হয়েছে। বলার স্টাইল, ফিগার, ধরন ও শৈলিভেদে এর সামান্য অমিল, নানা অর্থ বা সিনোনিম (সমার্থক) দাঁড়িয়েছে।

🔻বুঝার সুবিধার্থে প্রবাদ ও প্রবচন বিষয়ে আলাদা বিন্যাস-যেমন—

☑️অ্যাফরিজম (Aphorism):
প্রবাদ এক ধরনের অ্যাফরিজম।
☑️ ম্যাক্সিম (Maxim): ম্যাক্সিম’র ধরনও প্রবাদ বা অ্যাফরিজম’র কাছাকাছি বা একই।  তবে একটু সংকীর্ণ। এখানে রচয়িতার বিশেষ দৃষ্টিকে বড়ো করে দেখা হয়, এবং আকারে দীর্ঘ।
☑️পঁসে (Pensee): পঁসে অ্যাফরিজম ও এক্সিমের মতো। পার্থক্য হলো, পঁসে একবাক্যের হতে পারে আবার কয়েক পাতারও হতে পারে।
☑️সেন্টেনশিয়া (Sententia):সেন্টেনশিয়াও প্রবাদের মতো। একই ধরনের। তবে নিন্দা প্রকাশের ভাষা হিসেবে এটি বেশি ব্যবহৃত হয়। (উল্লেখসূত্র: হুমায়ূন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ)

☑️শাস্ত্র মতে প্রবাদ প্রবচনের (মূল সংজ্ঞা) ব্যাকরণসম্মত রূপ এবং আজকের বাস্তবতা (পর্যায়ক্রমে) সুনির্দিষ্ট পার্থক্য অনুসারে খুব সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
🔲 প্রবাদ প্রবচন পর্ব: ‘প্রবাদ ও প্রবচনের সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য হলো প্রবাদ লোকসমাজ বা কালের সৃষ্টি। কিন্তু প্রবচন কবি, সাহিত্যিক বা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সৃষ্টি।[১] প্রবাদের কোনো লিখিত ভিত্তি নেই, কিন্তু প্রবচনের আছে। প্রবাদকে বলা যায়, লোকসমাজের অভিজ্ঞতার নির্যাস, একক কোনো ব্যক্তি এর রচয়িতা হিসেবে দাবি করতে পারে না। অন্যদিকে প্রবচন ব্যক্তিগত প্রতিভার দ্বারা সৃষ্ট বাক্য বা বাক্যাংশ। তবে, প্রবচন একসঙ্গে লোকসমাজের অধিকারে চলে আসে।’ সূত্র: উইকিপিডিয়া।

☑️সামান্য সার-উপলব্ধি এবং কিছু প্রবাদ প্রবচন:

প্রবাদ প্রবচন: শুধু মাত্র ব্যাকরণ বা আভিধানিক অর্থেই এর তাৎপর্য নিহিত নয়। শাস্ত্রে বা বইতে প্রবাদ প্রবচনের আক্ষরিক অর্থ একই মনে হয়। পার্থক্য ধরাটা দুরুহ ব্যাপার। শুধু ভাবার্থে কিছু পার্থক্য আছে। তাও পাঠ-অভ্যাসের চর্চা থেকেই তা ভালোভাবে আলাদা করা যায়। প্রবাদ প্রবচনভেদে (বাগধারার মতো) এখানেও আছে জীবনের গভীরতা। গূঢ় বাস্তবতা। আছে এক ধরনের চমক। চিন্তা করার অবকাশ। ভাবনা করার সুযোগ। বুঝার সুযোগ। উপলব্ধি করার সুযোগ। কিছু প্রবাদ প্রবচন যেমন: অতি লোভে তাঁতি নষ্ট, যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল, ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনো, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, কেঁচো খুঁড়তে সাপ, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ, কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নাই, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ইত্যাদি।

☑️তাৎপর্য, উপযোগিতা, বৈপরীত্য: এক্সটেনশান হিসেবে, বিবিধ ঘটনা-রটনা-কিংবদন্তি ও গাল্পিক সহযোগে প্রবাদ প্রবচনের তাৎপর্য এবং বৈপরীত্যগুলো কী কী তার সারমর্মটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করবো। এছাড়াও সময়ের-প্রেক্ষিতে (পর্যায়ক্রমে মোটাদাগে) কিছু প্রবাদ প্রবচনের উল্লেখ সহ তার উপযোগিতা কোন পর্যায়ে আছে তাও বুঝার চেষ্টা করবো।

🔘 অতি লোভে তাঁতি নষ্ট: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ অতিরিক্ত আশা করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা)।

# মসলিন কাপড় উৎপাদন দিয়ে বঙ্গদেশে কুটিরশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলা তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। এটি হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অংশ। সুলতানী ও মুঘল যুগের উত্তরাধিকারী হিসেবে এই তাঁতশিল্পের আলাদা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করার মতো। ইউরোপের শিল্পবিপ্লব, ব্রিটিশ আমলের কর ব্যবস্থাপনা, নানা বিধি নিষেধ সহ সব মিলিয়ে এই শিল্প আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাসহ বাপদাদার সূত্রে প্রাপ্ত পুরনো এই পেশাকে অনেকে ধরে রেখেছেন। নৃতাত্ত্বিক জায়গা থেকেও যদি চিন্তা করা হয়, এরা আমাদের মাটিজাত শিল্পের বড়ো উত্তরাধিকার। যেখানে জেলে, কামার, কুমার, তাঁতি, ডোম, হাড়ি বাংলার আদি মানুষের ইতিহাসের অংশ। একটাসময় পেশা হিসেবে তাঁতিদের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থান ছিলো। তাঁত এবং তাঁতি-জীবনের সুখ-দু:খ-আনন্দ-বেদনা ও বৈপরীত্যের নানা উপস্থিতি থেকেই তৈরি হতে পারে ‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’র মতো বিশেষ উদাহরণ সমৃদ্ধ এই জনপ্রিয় প্রবাদ। 

🔘যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ অতি দুষ্টু লোকের প্রতি আঘাত অনুযায়ী প্রতিঘাত করা)।

# ওল খাওয়ার পর গলার চুলকানি বন্ধ করার উত্তম ওষুধ এই তেঁতুল বা টক। ওল, কচু, মান এই তিনই সমান বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। একই রূপ বা স্বজাত (একই জাত) বুঝানোর জন্যই এটা বলা। কাও কে বকা বা তাচ্ছিল্য করতে এই কচু শব্দটি আমরা এখনো ব্যবহার করি। যেমন— কচু! কচু কথা! কচুর লতা! সে একটা কচু! এমন শব্দে অনেকে বকা থেকে শুরু করে (চ-বর্গীয় ম-বর্গীয়) একেবারে গালি পর্যায়েও নিয়ে যেতে দেখা যায়। কচু কে তাচ্ছিল্য করে দেখার অভ্যাস টা মজ্জাগত হয়ে গেছে। চটকদার কর্পোরাল, এই বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায় পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই খাবারের কী বায়বীয় ব্যবহার! হয়তো কচুর অবয়ব বা বহিরাঙ্গ না-সুন্দর (সুন্দর নয়) হওয়ায় এমন তুচ্ছ করা! যা সত্যি অবাক করার মতো। যদিও স্বাস্থ্যসচেতন ও নিরামিষ প্রিয় ব্যক্তিরা রান্নার ব্যঞ্জনে কচু বা কচুজাতীয় উদ্ভিজ্জকে খুব গুরুত্ব সহকারে ব্যবহার করে থাকেন। পরিবেশবান্ধব এই ওল বাংলার মাটিময় চেহারার সাথে কী চমৎকার ভাবে মিশে আছে। তাই পরিবেশ ও পরিপার্শ্বের খুব কাছের জিনিস হিসেবে ওল শব্দ দিয়ে এর শত্রু গণ্য করে বিপরীতে বাঁঘা তেঁতুল শব্দটার (ওল খাওয়ার পর গলা চুলকানি তে টক যেহেতু ভাল কাজ করে) ব্যবহার আমরা করে থাকি। যদিও এই প্রবাদের খুব বেশি মৌখিক প্রচলন না থাকলেও বই বা পাঠ্য তালিকায় এর ব্যবহার এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে।

🔘 ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনো: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ দয়াপ্রার্থী হয়ে ঢুকে বিরাট অনিষ্ট করে চলে যাওয়া)।

# এখানে ছুঁচ শব্দটা সুঁই এর কথ্য বা বলন রূপ। যার সাথে ছিষ্টি বা ফোঁড় শব্দটা জড়িত। অঞ্চলভেদে উচ্চারণে সামান্য পার্থক্য থাকলেও মোটাদাগে এটা সবার খুব পরিচিত এবং নিত্য ব্যবহার্য একটি অংশ। বাংলার ঘরে ঘরে এখনো বড়ো বা ছোটোখাটো সেলাই কাজে সুঁই এর ব্যবহার মজ্জাগত। একটাসময় ভরা বর্ষা বাদলে বাংলার মাঠ-ঘাট পানিতে (অঞ্চলভেদে এখনো আছে) থৈ থৈ করতো। তখন বাংলার গৃহিনীরা সুঁই দিয়ে কাঁথা-বালিশের কাভারে, রুমালে ফুল তোলা সহ ছোট খাটো অনেক কাজে এই সুঁইয়ের ব্যবহার এখনো প্রচলিত আছে। যদিও সময় ও ব্যবহারভেদে  এর প্রায়োগিক ও বাহ্যিক অবয়ব আরো দৃষ্টিনন্দন ও প্রযুক্তি-ঘনিষ্ট হয়েছে। সুতরাং নিত্য ব্যবহার্য এই সুঁই (ছুঁচ) শব্দের সাথে যোগ হয়েছে ফাল। ফাল শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাঙালির একসময়ের নিত্য ব্যবহার্য লাঙ্গলের (লাঙলের অগ্রভাগের অংশ, এছাড়াও শাস্ত্রে এই শব্দ মহাদেব/বলরামের সমার্থক) একটি অংশ ছিলো। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবহারিক বস্তু হিসেবে দু’য়ের ঘনিষ্ট মিলনে তৈরি হয়েছে ‘ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনো’ এই প্রবাদ।

🔘 নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ প্রবল দারিদ্র্যে দিন অতিবাহিত করা)।

# নুন আর পান্তা। এই দুই শব্দযোগ কৃষি ভিত্তিক বা নদীমাতৃক বাংলার একটি বড়ো প্রতিকী তাৎপর্য তৈরি করেছে। এবং প্রতিদিনের ভাত অথবা পান্তার সাথে নুন মাখিয়ে খাওয়ার উপযোগী করা। এবং পিঁয়াজ, বাটা মরিচ বা মরিচ পোঁড়া শব্দগুলোর সাথেও একটা অনবদ্য যোগাযোগ কোনো মতেই ফেলনা নয়। কালের কণ্ঠে এই প্রবাদ যেনো মানুষের অবস্থা, পরিণতি এবং নিয়তির সাথে মিশে গেছে। এই প্রযুক্তি-যুগেও নিজের অবস্থা বা পরিণতি নিশ্চিত করার জন্য অথবা হা হুতাশ প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে (এমনকি কেতাদুরস্ত বিত্তবান মানুষও) আমরা এই পুরনো প্রবাদ ব্যবহার করে থাকি।

🔘 কেঁচো খুঁড়তে সাপ: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ তুচ্ছ বিষয়ের সূত্রে জটিল সমস্যার উদ্ভব)।

# বাংলার ফসলি মাঠে বা জমিতে এই কেঁচো আর জলা জংলায় সাপের চলন (বিস্তার) এই দু’টার সাথে বড়ো একটা যোগসূত্র কোনো মতেই অস্বীকার করা যাবে না। গোয়াল ঘরে অথবা পাকের ঘরের কোনায় নীরবে সাপের ব্যাঙ খাওয়া দেখার অভিজ্ঞতা অনেকের আছে। এটি গ্রামে বসবাস রত মানুষের একটা সহজ অভিজ্ঞতার অংশ। বিশেষ করে ঘন-বন বা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা সমতল বা পাহাড়ি জনপদের স্বাভাবিক চিত্র এটি। শাস্ত্রমতে কেঁচোকে প্রকৃতির লাঙ্গল বলে। এই কেঁচো আর লাঙ্গল(ব্যবহারিক বস্তু) দু’টোর মধ্যে সৃষ্টি আর উর্বরার বড়ো একটা প্রতীকি তাৎপর্য রয়েছে। সুতরাং এই দুই শব্দযোগে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ প্রবাদটির সৃষ্টি অস্বীকার করা যাবে না।

🔘 বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ বাপের চেয়ে ছেলের তেজ বেশি)।

# বাঁশ আর কঞ্চি দু’টার মধ্যেই পারস্পরিক (ওতপ্রোত) যোগাযোগ আছে। বাঁশ যেখানে আছে সেখানে কঞ্চি থাকবেই। ঘরের পাশে বাঁশ ঝাড় গ্রাম বাংলার সহজ চিত্র। বাংলা সাহিত্যেও কতো গল্প, উপন্যাস, কবিতায় বাঁশ ঝাড় কে উপমা (তুলনা) হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরিবেশ ও প্রকৃতিভেদে বাংলার বাঁশ ঝাড়ের আলাদা একটা ভুতোময় উপস্থিতি রয়েছে। এ নিয়ে কতো কিংবদন্তি চালু আছে। বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ ওঠেছে ঐ’ খুবই জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত কবিতার উদাহরণ। (যতীন্দ্র মোহন বাগচি, ‘কামনা দিদি’ কবিতা’)। এখন সেই বাঁশ ঝাড় নেই। নেই বাঁশ বন। উপমা হিসেবে বলতে হয়—অ্যাপাটমেন্টের মাথার ওপর চাঁদ দেখা যায় ঐ অথবা (বাস্তবতাভেদে) বলা যেতে অ্যাপার্টমেন্টের মাথার ওপর চাঁদটা গেলো কৈ!—এমন খেদোক্তি বা আফসোস আমরা করতেই পারি। পরিবেশ ও গার্হস্থ্য জীবনের খুবই কাছের জায়গা বা নিকটবর্তী হিসেবে বাঁশ এবং কঞ্চি এই দুই শব্দযোগে (বা উৎসযোগে) ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’ এই প্রবাদের সৃষ্টি অস্বীকার করা যাবে না।

🔘 যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ:(শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ ক্ষমতা পেলে সব লোকের স্বভাব এক রকমই হয়)।

# আর্য সাহিত্যে জোর যার মুল্লুক তার এর মতো অনার্য রাবণ কে (সিনোনিমে এবং আক্ষরিক অর্থভেদে যা কে রাঘব বা রাক্ষসও বলে) বানানো হয়েছে একটা ভয়ঙ্কর চরিত্র হিসেবে। ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ এ মাইকেল মধুসূদন যে চরিত্র কে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়েছিলেন। যার মধ্যে দিয়ে আমরা রাবণের যথার্থ পরিচয় পাই বলে ধরি। রাবণের মধ্য দিয়ে আমরা পাক-ভারত উপমহাদেশের (পুরো বিশ্ব সাহিত্য) মহাকাব্য রামায়ন’র একটি বিশেষ চরিত্র এবং লঙ্কার একটি ঐতিহাসিক চরিত্র সম্পর্কে অবগত হই। মাঝেমধ্যে উদাহরণ হিসেবে সনাতন ধর্মীয় চেতনা এবং সাহিত্যিক মূল্যে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য কম নয়।

🔘 কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ বাস্তবে না থাকা)।

# কাজি আর গরু। গরু আর কাজি। দুই মিলে হলো নানা ভুজবাজি। বই, কেতাবে বা শাস্ত্রে কাজির গরু ঠিকই আছে। কিন্তু বাস্তবে আছে কী না এই দ্বন্দ্বে প্রায়শ এই উদাহরণ ব্যবহারের চল্ এখনো আছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় হিসাব কিতাবের গরমিলে এই প্রবাদের ব্যবহার শ্রেষ্ঠ একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। জিনিস কেনা হলো দশ টাকার, দেখানো হলো হাজার টাকা! এখানে কাজি শব্দের মানে (একজন এক্সপার্ট) যা কে দিয়ে উদ্দেশ্য সাধন হবে। এছাড়াও বিবাহ চুক্তি সম্পাদনা অথবা গোপন প্রেমের বিয়ে সম্পাদনায় এই শব্দের (স্থান-কাল পাত্রভেদে) ব্যবহার দেখা যায়। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ধরেই এর প্রচলিত ব্যবহার বেশি দেখা যায়।

🔘 বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ বুড়ো বয়সে অসংলগ্ন আচরণ)।

# বুড়ো মানে বয়স্ক বা বৃদ্ধ। শালিক মানে পাখি।
আর রোঁ শব্দের অর্থ ভীমরতি। বাংলা সাহিত্যে ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (মাইকেল মধুসূদন রচিত) একটি বিখ্যাত প্রহসনমূলক রচনা। বুড়ো বয়সে মতিভ্রম হলে অথবা শিশুর মতো অসংলগ্ন আচরণ করলে আমরা বলি বুইড়ার খাসলত খারাপ! অথবা বুইজ্জার হাসিয়ত/খাসিয়ত খারাপ (অঞ্চলভেদে একেক ঢঙে) যার প্রমিত (শুদ্ধ) রূপ হলো ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’।প্রজাতিভেদে শালিক পাখির আচরণেও তারতম্য আছে। শালিক প্রজাতির মধ্যে ময়না পাখিও আছে। যারা মানুষের শেখানো কথা কে বুলির মতো আওড়াতে ওস্তাদ। ঝগড়াটে হিসেবেও শালিকের পরিচিতি আছে। তাছাড়া এরা মানুষের বসবাসের খুব কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। প্রজাতিভেদে শালিকের আচরণের এমন বৈচিত্র্যের কারণে শালিক শব্দ আর রোঁ শব্দ মিলিয়ে উল্লেখিত প্রবাদ একটি দারুণ অনুসঙ্গ তৈরি করেছে। যা কিছুটা সাহিত্য ছাড়িয়েও সাধারণ্যে এই প্রবাদ গুরুত্ব ও তাৎপর্য পেয়েছে।

🔘 বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ বদলোকের পাল্লায় পড়ে নাজেহাল হওয়া)।

# পাক-ভারত উপমহাদেশে (ঐতিহাসিকভাবে) পশু হিসেবে বাঘের রয়েছে আলাদা একটি শক্তি ও গাম্ভীর্য।
এটি সক্ষমতার বড়ো একটা প্রতীকি তাৎপর্য বহন করে। সুন্দরবন তার একটি বড়ো প্রমাণ। যে বনে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কাল-ধারায় এই বাঘ বাংলাদেশে জাতীয় পশুর মর্যাদা পেয়েছে। বাঘের শক্তি এবং ক্ষমতা আমরা মানুষের ভেতরেও রূপান্তর (ট্রান্সফার) করেছি। যেমন, পুলিশী ক্ষমতার অপব্যবহারকে ব্যাঙ্গার্থে বলা হয়, ‘বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা পুলিশ ছুঁলে ৩৬ ঘা’। মনুষ্য ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তাদের দাপট বুঝাতে উল্লেখিত প্রবাদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অস্বীকার করা যাবে না। (চলবে...)

# ১৮/০৬/২০ খ্রি.____

সংগৃহীত

বাগধারা, প্রবাদ, প্রবচন ও খনাযোগ) আজিজ কাজল———

প্রাচীন ও মধ্যযুগের অনেক প্রবাদ প্রবচনে সেই সময়ের পরিবেশ, প্রকৃতি, চিন্তা, আবহ, যাপন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিছু বাক্যের অর্থ অনুমান নির্ভর। যা আইডিয়া দিয়ে বুঝে নিতে হয়। কিছু প্রবাদ প্রবচনে বাক্যের শব্দ চয়ন অনেক পুরনো। এই প্রযুক্তি-যুগে আমরা এমন বাক্যে (প্রবাদ প্রবচনে) সমার্থক শব্দ বা সিনোনিম ব্যবহার করি। কিছু প্রবাদ প্রবচনের (বইতে আছে) ব্যবহার বর্তমানে খুবই কম। আবার কিছু প্রবাদ প্রবচন পড়লে মনে হবে ঠিক এই সময়ে লেখা।। অথচ উল্লেখিত শব্দের বিকল্প সমার্থক (সিনোনিম) ব্যবহার করে এই আধুনিক বা প্রযুক্তি-যুগেও তা কতো প্রাসঙ্গিক। যেমন’ ‘আপনা মাংশে হরিণা বৈরি’। ভুসুকু পা’র বিখ্যাত এই (ভুসুকুপা রচিত পদ: ৬ এর পঙক্তি) পঙক্তি প্রবাদের মর্যাদায় অনবদ্য। সান্ধ্য ভাষা হয়েও চর্যাপদের বিশেষত্বের কারণে এটি আলাদা মাহাত্ম্য পেয়েছে। এছাড়াও মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র’র লেখা যেমন— ‘কড়িতে বাঘের দুধ মেলে’। এই কড়ির জায়গায় এখন টাকা শব্দটির ব্যবহার আছে। অর্থাৎ টাকা তে বাঘের দুধ মেলে অথবা টাকা দিলে বাঘের চোখ মেলে এমন ব্যবহার খুবই প্রচলিত। আরো যেমন—
‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী’ কাশিরাম দাস।
‘জামাতা ভাগিনা যম আপনার নয়’ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? - ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর।
‘পিপীলিকার পাখা হয় মরিবার তরে’ - কবি কঙ্কন চণ্ডী।

কিছু পার্থক্য নিরুপন করলেও প্রবাদের সাথে (প্রবচন প্রবচন) প্রবচন শব্দটা লাগানো আছেই। বইতে (শাস্ত্রে) এভাবেই পাঠ্য হচ্ছে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ’র ধারণা দিয়ে তা আরেকটু পরিষ্কার করা যায়। তিনি বলছেন—‘প্রবাদের মধ্যে একটা গল্পের আভাস থাকে। কিন্তু প্রবচন হচ্ছে ছাঁটা-কাটা কথা’।

🔲 পশ্চিমা মতে প্রবাদ ও প্রবচন:
প্রবাদ ও প্রবচন বিষয়ে আরেকটু সংক্ষেপ আলোচনায়—এ বিষয়ে পশ্চিমী ধারণা কী বলে? তা জানলে প্রবাদ ও প্রবচন বিষয়ে টোটাল বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা যাবে। ইংরেজিতে অ্যাফরিজম (Aphorism), ম্যাক্সিম (Maxim), পঁসে (Pensee), সেন্টেনশিয়া (Sententia) প্রবাদ (Proverb) এই শব্দগুলোর পারস্পরিক কিছু অন্তর্গত মিল অমিল ও সংযোগ তৈরি হয়েছে। বলার স্টাইল, ফিগার, ধরন ও শৈলিভেদে এর সামান্য অমিল, নানা অর্থ বা সিনোনিম (সমার্থক) দাঁড়িয়েছে।

🔻বুঝার সুবিধার্থে প্রবাদ ও প্রবচন বিষয়ে আলাদা বিন্যাস-যেমন—

☑️অ্যাফরিজম (Aphorism):
প্রবাদ এক ধরনের অ্যাফরিজম।
☑️ ম্যাক্সিম (Maxim): ম্যাক্সিম’র ধরনও প্রবাদ বা অ্যাফরিজম’র কাছাকাছি বা একই।  তবে একটু সংকীর্ণ। এখানে রচয়িতার বিশেষ দৃষ্টিকে বড়ো করে দেখা হয়, এবং আকারে দীর্ঘ।
☑️পঁসে (Pensee): পঁসে অ্যাফরিজম ও এক্সিমের মতো। পার্থক্য হলো, পঁসে একবাক্যের হতে পারে আবার কয়েক পাতারও হতে পারে।
☑️সেন্টেনশিয়া (Sententia):সেন্টেনশিয়াও প্রবাদের মতো। একই ধরনের। তবে নিন্দা প্রকাশের ভাষা হিসেবে এটি বেশি ব্যবহৃত হয়। (উল্লেখসূত্র: হুমায়ূন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ)

☑️শাস্ত্র মতে প্রবাদ প্রবচনের (মূল সংজ্ঞা) ব্যাকরণসম্মত রূপ এবং আজকের বাস্তবতা (পর্যায়ক্রমে) সুনির্দিষ্ট পার্থক্য অনুসারে খুব সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
🔲 প্রবাদ প্রবচন পর্ব: ‘প্রবাদ ও প্রবচনের সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য হলো প্রবাদ লোকসমাজ বা কালের সৃষ্টি। কিন্তু প্রবচন কবি, সাহিত্যিক বা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সৃষ্টি।[১] প্রবাদের কোনো লিখিত ভিত্তি নেই, কিন্তু প্রবচনের আছে। প্রবাদকে বলা যায়, লোকসমাজের অভিজ্ঞতার নির্যাস, একক কোনো ব্যক্তি এর রচয়িতা হিসেবে দাবি করতে পারে না। অন্যদিকে প্রবচন ব্যক্তিগত প্রতিভার দ্বারা সৃষ্ট বাক্য বা বাক্যাংশ। তবে, প্রবচন একসঙ্গে লোকসমাজের অধিকারে চলে আসে।’ সূত্র: উইকিপিডিয়া।

☑️সামান্য সার-উপলব্ধি এবং কিছু প্রবাদ প্রবচন:

প্রবাদ প্রবচন: শুধু মাত্র ব্যাকরণ বা আভিধানিক অর্থেই এর তাৎপর্য নিহিত নয়। শাস্ত্রে বা বইতে প্রবাদ প্রবচনের আক্ষরিক অর্থ একই মনে হয়। পার্থক্য ধরাটা দুরুহ ব্যাপার। শুধু ভাবার্থে কিছু পার্থক্য আছে। তাও পাঠ-অভ্যাসের চর্চা থেকেই তা ভালোভাবে আলাদা করা যায়। প্রবাদ প্রবচনভেদে (বাগধারার মতো) এখানেও আছে জীবনের গভীরতা। গূঢ় বাস্তবতা। আছে এক ধরনের চমক। চিন্তা করার অবকাশ। ভাবনা করার সুযোগ। বুঝার সুযোগ। উপলব্ধি করার সুযোগ। কিছু প্রবাদ প্রবচন যেমন: অতি লোভে তাঁতি নষ্ট, যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল, ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনো, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, কেঁচো খুঁড়তে সাপ, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ, কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নাই, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ইত্যাদি।

☑️তাৎপর্য, উপযোগিতা, বৈপরীত্য: এক্সটেনশান হিসেবে, বিবিধ ঘটনা-রটনা-কিংবদন্তি ও গাল্পিক সহযোগে প্রবাদ প্রবচনের তাৎপর্য এবং বৈপরীত্যগুলো কী কী তার সারমর্মটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করবো। এছাড়াও সময়ের-প্রেক্ষিতে (পর্যায়ক্রমে মোটাদাগে) কিছু প্রবাদ প্রবচনের উল্লেখ সহ তার উপযোগিতা কোন পর্যায়ে আছে তাও বুঝার চেষ্টা করবো।

🔘 অতি লোভে তাঁতি নষ্ট: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ অতিরিক্ত আশা করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা)।

# মসলিন কাপড় উৎপাদন দিয়ে বঙ্গদেশে কুটিরশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলা তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। এটি হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অংশ। সুলতানী ও মুঘল যুগের উত্তরাধিকারী হিসেবে এই তাঁতশিল্পের আলাদা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করার মতো। ইউরোপের শিল্পবিপ্লব, ব্রিটিশ আমলের কর ব্যবস্থাপনা, নানা বিধি নিষেধ সহ সব মিলিয়ে এই শিল্প আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাসহ বাপদাদার সূত্রে প্রাপ্ত পুরনো এই পেশাকে অনেকে ধরে রেখেছেন। নৃতাত্ত্বিক জায়গা থেকেও যদি চিন্তা করা হয়, এরা আমাদের মাটিজাত শিল্পের বড়ো উত্তরাধিকার। যেখানে জেলে, কামার, কুমার, তাঁতি, ডোম, হাড়ি বাংলার আদি মানুষের ইতিহাসের অংশ। একটাসময় পেশা হিসেবে তাঁতিদের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থান ছিলো। তাঁত এবং তাঁতি-জীবনের সুখ-দু:খ-আনন্দ-বেদনা ও বৈপরীত্যের নানা উপস্থিতি থেকেই তৈরি হতে পারে ‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’র মতো বিশেষ উদাহরণ সমৃদ্ধ এই জনপ্রিয় প্রবাদ। 

🔘যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ অতি দুষ্টু লোকের প্রতি আঘাত অনুযায়ী প্রতিঘাত করা)।

# ওল খাওয়ার পর গলার চুলকানি বন্ধ করার উত্তম ওষুধ এই তেঁতুল বা টক। ওল, কচু, মান এই তিনই সমান বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। একই রূপ বা স্বজাত (একই জাত) বুঝানোর জন্যই এটা বলা। কাও কে বকা বা তাচ্ছিল্য করতে এই কচু শব্দটি আমরা এখনো ব্যবহার করি। যেমন— কচু! কচু কথা! কচুর লতা! সে একটা কচু! এমন শব্দে অনেকে বকা থেকে শুরু করে (চ-বর্গীয় ম-বর্গীয়) একেবারে গালি পর্যায়েও নিয়ে যেতে দেখা যায়। কচু কে তাচ্ছিল্য করে দেখার অভ্যাস টা মজ্জাগত হয়ে গেছে। চটকদার কর্পোরাল, এই বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায় পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই খাবারের কী বায়বীয় ব্যবহার! হয়তো কচুর অবয়ব বা বহিরাঙ্গ না-সুন্দর (সুন্দর নয়) হওয়ায় এমন তুচ্ছ করা! যা সত্যি অবাক করার মতো। যদিও স্বাস্থ্যসচেতন ও নিরামিষ প্রিয় ব্যক্তিরা রান্নার ব্যঞ্জনে কচু বা কচুজাতীয় উদ্ভিজ্জকে খুব গুরুত্ব সহকারে ব্যবহার করে থাকেন। পরিবেশবান্ধব এই ওল বাংলার মাটিময় চেহারার সাথে কী চমৎকার ভাবে মিশে আছে। তাই পরিবেশ ও পরিপার্শ্বের খুব কাছের জিনিস হিসেবে ওল শব্দ দিয়ে এর শত্রু গণ্য করে বিপরীতে বাঁঘা তেঁতুল শব্দটার (ওল খাওয়ার পর গলা চুলকানি তে টক যেহেতু ভাল কাজ করে) ব্যবহার আমরা করে থাকি। যদিও এই প্রবাদের খুব বেশি মৌখিক প্রচলন না থাকলেও বই বা পাঠ্য তালিকায় এর ব্যবহার এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে।

🔘 ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনো: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ দয়াপ্রার্থী হয়ে ঢুকে বিরাট অনিষ্ট করে চলে যাওয়া)।

# এখানে ছুঁচ শব্দটা সুঁই এর কথ্য বা বলন রূপ। যার সাথে ছিষ্টি বা ফোঁড় শব্দটা জড়িত। অঞ্চলভেদে উচ্চারণে সামান্য পার্থক্য থাকলেও মোটাদাগে এটা সবার খুব পরিচিত এবং নিত্য ব্যবহার্য একটি অংশ। বাংলার ঘরে ঘরে এখনো বড়ো বা ছোটোখাটো সেলাই কাজে সুঁই এর ব্যবহার মজ্জাগত। একটাসময় ভরা বর্ষা বাদলে বাংলার মাঠ-ঘাট পানিতে (অঞ্চলভেদে এখনো আছে) থৈ থৈ করতো। তখন বাংলার গৃহিনীরা সুঁই দিয়ে কাঁথা-বালিশের কাভারে, রুমালে ফুল তোলা সহ ছোট খাটো অনেক কাজে এই সুঁইয়ের ব্যবহার এখনো প্রচলিত আছে। যদিও সময় ও ব্যবহারভেদে  এর প্রায়োগিক ও বাহ্যিক অবয়ব আরো দৃষ্টিনন্দন ও প্রযুক্তি-ঘনিষ্ট হয়েছে। সুতরাং নিত্য ব্যবহার্য এই সুঁই (ছুঁচ) শব্দের সাথে যোগ হয়েছে ফাল। ফাল শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাঙালির একসময়ের নিত্য ব্যবহার্য লাঙ্গলের (লাঙলের অগ্রভাগের অংশ, এছাড়াও শাস্ত্রে এই শব্দ মহাদেব/বলরামের সমার্থক) একটি অংশ ছিলো। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবহারিক বস্তু হিসেবে দু’য়ের ঘনিষ্ট মিলনে তৈরি হয়েছে ‘ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনো’ এই প্রবাদ।

🔘 নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ প্রবল দারিদ্র্যে দিন অতিবাহিত করা)।

# নুন আর পান্তা। এই দুই শব্দযোগ কৃষি ভিত্তিক বা নদীমাতৃক বাংলার একটি বড়ো প্রতিকী তাৎপর্য তৈরি করেছে। এবং প্রতিদিনের ভাত অথবা পান্তার সাথে নুন মাখিয়ে খাওয়ার উপযোগী করা। এবং পিঁয়াজ, বাটা মরিচ বা মরিচ পোঁড়া শব্দগুলোর সাথেও একটা অনবদ্য যোগাযোগ কোনো মতেই ফেলনা নয়। কালের কণ্ঠে এই প্রবাদ যেনো মানুষের অবস্থা, পরিণতি এবং নিয়তির সাথে মিশে গেছে। এই প্রযুক্তি-যুগেও নিজের অবস্থা বা পরিণতি নিশ্চিত করার জন্য অথবা হা হুতাশ প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে (এমনকি কেতাদুরস্ত বিত্তবান মানুষও) আমরা এই পুরনো প্রবাদ ব্যবহার করে থাকি।

🔘 কেঁচো খুঁড়তে সাপ: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ তুচ্ছ বিষয়ের সূত্রে জটিল সমস্যার উদ্ভব)।

# বাংলার ফসলি মাঠে বা জমিতে এই কেঁচো আর জলা জংলায় সাপের চলন (বিস্তার) এই দু’টার সাথে বড়ো একটা যোগসূত্র কোনো মতেই অস্বীকার করা যাবে না। গোয়াল ঘরে অথবা পাকের ঘরের কোনায় নীরবে সাপের ব্যাঙ খাওয়া দেখার অভিজ্ঞতা অনেকের আছে। এটি গ্রামে বসবাস রত মানুষের একটা সহজ অভিজ্ঞতার অংশ। বিশেষ করে ঘন-বন বা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা সমতল বা পাহাড়ি জনপদের স্বাভাবিক চিত্র এটি। শাস্ত্রমতে কেঁচোকে প্রকৃতির লাঙ্গল বলে। এই কেঁচো আর লাঙ্গল(ব্যবহারিক বস্তু) দু’টোর মধ্যে সৃষ্টি আর উর্বরার বড়ো একটা প্রতীকি তাৎপর্য রয়েছে। সুতরাং এই দুই শব্দযোগে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ প্রবাদটির সৃষ্টি অস্বীকার করা যাবে না।

🔘 বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ বাপের চেয়ে ছেলের তেজ বেশি)।

# বাঁশ আর কঞ্চি দু’টার মধ্যেই পারস্পরিক (ওতপ্রোত) যোগাযোগ আছে। বাঁশ যেখানে আছে সেখানে কঞ্চি থাকবেই। ঘরের পাশে বাঁশ ঝাড় গ্রাম বাংলার সহজ চিত্র। বাংলা সাহিত্যেও কতো গল্প, উপন্যাস, কবিতায় বাঁশ ঝাড় কে উপমা (তুলনা) হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরিবেশ ও প্রকৃতিভেদে বাংলার বাঁশ ঝাড়ের আলাদা একটা ভুতোময় উপস্থিতি রয়েছে। এ নিয়ে কতো কিংবদন্তি চালু আছে। বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ ওঠেছে ঐ’ খুবই জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত কবিতার উদাহরণ। (যতীন্দ্র মোহন বাগচি, ‘কামনা দিদি’ কবিতা’)। এখন সেই বাঁশ ঝাড় নেই। নেই বাঁশ বন। উপমা হিসেবে বলতে হয়—অ্যাপাটমেন্টের মাথার ওপর চাঁদ দেখা যায় ঐ অথবা (বাস্তবতাভেদে) বলা যেতে অ্যাপার্টমেন্টের মাথার ওপর চাঁদটা গেলো কৈ!—এমন খেদোক্তি বা আফসোস আমরা করতেই পারি। পরিবেশ ও গার্হস্থ্য জীবনের খুবই কাছের জায়গা বা নিকটবর্তী হিসেবে বাঁশ এবং কঞ্চি এই দুই শব্দযোগে (বা উৎসযোগে) ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’ এই প্রবাদের সৃষ্টি অস্বীকার করা যাবে না।

🔘 যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ:(শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ ক্ষমতা পেলে সব লোকের স্বভাব এক রকমই হয়)।

# আর্য সাহিত্যে জোর যার মুল্লুক তার এর মতো অনার্য রাবণ কে (সিনোনিমে এবং আক্ষরিক অর্থভেদে যা কে রাঘব বা রাক্ষসও বলে) বানানো হয়েছে একটা ভয়ঙ্কর চরিত্র হিসেবে। ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ এ মাইকেল মধুসূদন যে চরিত্র কে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়েছিলেন। যার মধ্যে দিয়ে আমরা রাবণের যথার্থ পরিচয় পাই বলে ধরি। রাবণের মধ্য দিয়ে আমরা পাক-ভারত উপমহাদেশের (পুরো বিশ্ব সাহিত্য) মহাকাব্য রামায়ন’র একটি বিশেষ চরিত্র এবং লঙ্কার একটি ঐতিহাসিক চরিত্র সম্পর্কে অবগত হই। মাঝেমধ্যে উদাহরণ হিসেবে সনাতন ধর্মীয় চেতনা এবং সাহিত্যিক মূল্যে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য কম নয়।

🔘 কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ বাস্তবে না থাকা)।

# কাজি আর গরু। গরু আর কাজি। দুই মিলে হলো নানা ভুজবাজি। বই, কেতাবে বা শাস্ত্রে কাজির গরু ঠিকই আছে। কিন্তু বাস্তবে আছে কী না এই দ্বন্দ্বে প্রায়শ এই উদাহরণ ব্যবহারের চল্ এখনো আছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় হিসাব কিতাবের গরমিলে এই প্রবাদের ব্যবহার শ্রেষ্ঠ একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। জিনিস কেনা হলো দশ টাকার, দেখানো হলো হাজার টাকা! এখানে কাজি শব্দের মানে (একজন এক্সপার্ট) যা কে দিয়ে উদ্দেশ্য সাধন হবে। এছাড়াও বিবাহ চুক্তি সম্পাদনা অথবা গোপন প্রেমের বিয়ে সম্পাদনায় এই শব্দের (স্থান-কাল পাত্রভেদে) ব্যবহার দেখা যায়। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ধরেই এর প্রচলিত ব্যবহার বেশি দেখা যায়।

🔘 বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ বুড়ো বয়সে অসংলগ্ন আচরণ)।

# বুড়ো মানে বয়স্ক বা বৃদ্ধ। শালিক মানে পাখি।
আর রোঁ শব্দের অর্থ ভীমরতি। বাংলা সাহিত্যে ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (মাইকেল মধুসূদন রচিত) একটি বিখ্যাত প্রহসনমূলক রচনা। বুড়ো বয়সে মতিভ্রম হলে অথবা শিশুর মতো অসংলগ্ন আচরণ করলে আমরা বলি বুইড়ার খাসলত খারাপ! অথবা বুইজ্জার হাসিয়ত/খাসিয়ত খারাপ (অঞ্চলভেদে একেক ঢঙে) যার প্রমিত (শুদ্ধ) রূপ হলো ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’।প্রজাতিভেদে শালিক পাখির আচরণেও তারতম্য আছে। শালিক প্রজাতির মধ্যে ময়না পাখিও আছে। যারা মানুষের শেখানো কথা কে বুলির মতো আওড়াতে ওস্তাদ। ঝগড়াটে হিসেবেও শালিকের পরিচিতি আছে। তাছাড়া এরা মানুষের বসবাসের খুব কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। প্রজাতিভেদে শালিকের আচরণের এমন বৈচিত্র্যের কারণে শালিক শব্দ আর রোঁ শব্দ মিলিয়ে উল্লেখিত প্রবাদ একটি দারুণ অনুসঙ্গ তৈরি করেছে। যা কিছুটা সাহিত্য ছাড়িয়েও সাধারণ্যে এই প্রবাদ গুরুত্ব ও তাৎপর্য পেয়েছে।

🔘 বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা: (শাস্ত্রমতে এর আক্ষরিক অর্থ বদলোকের পাল্লায় পড়ে নাজেহাল হওয়া)।

# পাক-ভারত উপমহাদেশে (ঐতিহাসিকভাবে) পশু হিসেবে বাঘের রয়েছে আলাদা একটি শক্তি ও গাম্ভীর্য।
এটি সক্ষমতার বড়ো একটা প্রতীকি তাৎপর্য বহন করে। সুন্দরবন তার একটি বড়ো প্রমাণ। যে বনে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কাল-ধারায় এই বাঘ বাংলাদেশে জাতীয় পশুর মর্যাদা পেয়েছে। বাঘের শক্তি এবং ক্ষমতা আমরা মানুষের ভেতরেও রূপান্তর (ট্রান্সফার) করেছি। যেমন, পুলিশী ক্ষমতার অপব্যবহারকে ব্যাঙ্গার্থে বলা হয়, ‘বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা পুলিশ ছুঁলে ৩৬ ঘা’। মনুষ্য ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তাদের দাপট বুঝাতে উল্লেখিত প্রবাদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অস্বীকার করা যাবে না। (চলবে...)

# ১৮/০৬/২০ খ্রি.____

সংগৃহীত

একুশের আক্ষেপানুরাগ

বেশ কয়েক বছর থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারির অঙ্গীকার ছিল অফিস আদালতে শতভাগ বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিদেশী ভাষার ব্যবহার কমানো, ব্যানার, ফেস...